অসহযোগিতার আবহই কাঁটা
কালো ব্যাগে কী নিলেন, মিলল না জবাব
সৌমেন দত্ত (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
বর্ধমান, ১১ অক্টোবর, ২০১৪,
শুক্রবার ভবানী ভবনে এনআইএ-রএসপি বিক্রম খালাটে (নীল জামা)। |
তত ক্ষণে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তভার নিতে সিআইডি-র সদর দফতর ভবানী ভবনে পৌঁছে গিয়েছেন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) গোয়েন্দারা। বর্ধমান জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জাও বর্ধমান সদর থানায় বসে সাংবাদিকদের জানাচ্ছেন, এনআইএ-কে সব রকম সহযোগিতা করা হবে।
এহেন সময়ে তড়িঘড়ি অকুস্থলে ঢুকে ওই এসআই ব্যাগ বোঝাই করে কী নিয়ে গেলেন, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্য। ওই অফিসারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি “কোনও মন্তব্য করব না” বলে গাড়িতে উঠে চলে যান। জেলা পুলিশ কর্তাদের ব্যাখ্যাতেও ধন্দ কাটেনি। জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বিস্ফোরণস্থলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রক্তমাখা জামাকাপড়, কিছু রাসায়নিক ও বিস্ফোরক তৈরির উপাদান, কার্তুজ, কাগজ, কাচের টুকরো ওই ব্যাগে করে ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।
এ দিনই দুপুরে বর্ধমান সদর থানায় পৌঁছন সিআইডি-র স্পেশ্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট সব্যসাচীরমণ মিশ্র। তিনি দফায়-দফায় সিআইডি-র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তার পরে সন্ধ্যা পৌনে ৬টা নাগাদ হঠাৎ সিআইডি-র একটি দল ফের ঘটনাস্থলে যায়। সঙ্গে ছিলেন খাগড়াগড়-কাণ্ডে জেলা পুলিশের তরফে মামলার তদন্তকারী অফিসার। সকালে পুলিশ ঠিক যা করেছিল, সেই ভাবেই সিআইডি-র এক কর্মী গাড়ি থেকে নেমে গেট খুলিয়ে উপরে যান। ঘটনাস্থলের ভিডিওগ্রাফি করে মিনিট পনেরো পরে পলিথিনের তিনটি প্যাকেটে কিছু বড় বড় কৌটো নিয়ে নেমে আসেন। কী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কেনই বা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে এই দলে থাকা কেউ কথা বলতে চাননি। গাড়ি নিয়ে বর্ধমান সদর থানায় ফেরেন তাঁরা।
তত ক্ষণে কলকাতায় আদালতের কাছে এফআইআর-এর অনুলিপি জমা দিয়ে তদন্তের স্বার্থে বিভিন্ন তথ্য ও অন্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি পেয়ে গিয়েছে এনআইএ।
বেলা ১২টা নাগাদ খাগড়াগড়ের বাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে বেরোচ্ছে পুলিশ (বাঁ দিকে)।
সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করার পর বেরিয়ে যাচ্ছে সিআইডি দল। শুক্রবার।
এনআইএ তদন্তভার নেওয়ার সময় রাজ্য পুলিশের এই তৎপরতা কেন, তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা প্রশাসন সূত্রে মেলেনি। পুলিশ সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, সিআইডি-র নির্দেশমতো ফরেন্সিক দফতরকে দেওয়ার জন্যই এ দিন নমুনা সংগ্রহ করা হয়। জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, সিআইডি এ দিন জেলা পুলিশকে ‘সিজার লিস্ট’ (ঘটনাস্থল থেকে বাজেয়াপ্ত করা জিনিসের তালিকা) তৈরির জন্য ঘটনাস্থল থেকে কিছু নমুনা সংগ্রহ করতে বলে। জেলা পুলিশের কর্মীরা এ দিন সে কাজই করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সিআইডি তো ৩ অক্টোবর থেকেই খাগড়াগড়ের বাড়ির জিম্মা নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে এত দিন বাদে ‘সিজার লিস্ট’ তৈরির জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হবে কেন? ওই পুলিশ-কর্তা বলেন, ‘‘ওরা এ দিনই নমুনা চেয়েছে। তাই লোক পাঠাই।”
সিআইডি যদিও দাবি করছে তারা ঘটনাস্থল থেকে কাউকে কিছু সংগ্রহ করতে বলেনি। তা হলে সন্ধ্যায় তাদের দল ওই বাড়িতে গেল কেন? সিআইডি-র এক সূত্রের দাবি, বিশেষ কিছু নমুনা থানায় রাখা নিরাপদ নয় বলে এত দিন খাগড়াগড়ের বাড়িটিতেই রাখা ছিল। সেগুলি আনতেই গিয়েছিল তাদের দল।
কিন্তু রাজ্য ফরেন্সিক ল্যাবোরেটরির এক অবসরপ্রাপ্ত কর্তার মতে, তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু নমুনা সংগ্রহের কাজটি করা হয় ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে। কারণ, সাধারণ পুলিশ কর্মীদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণই নেই। ফলে বিশেষজ্ঞের অনুপস্থিতিতে নমুনা সংগ্রহের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হয়নি পুলিশেরই একটি বড় অংশের কাছেই।
বিশেষ করে যখন বিস্ফোরণের পর থেকেই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তদন্তে অসহযোগিতা করার অভিযোগ তুলছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। সরব বিরোধীরাও। এনআইএ তদন্তের নির্দেশ হয়ে যাওয়ার পরেও বিস্ফোরণ-স্থলে গিয়ে নতুন করে নমুনা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর অভিযোগ, তৃণমূলের স্বার্থেই পুলিশ-প্রশাসন শেষ পর্যন্ত তথ্য আড়ালের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁর কথায়, “এখন নাকি ভিডিওগ্রাফি করা হচ্ছে! ঘটনার আট দিন পরে এ সব করে কী পাবে পুলিশ? আসলে প্রথম থেকেই চেষ্টা হচ্ছে কিছু আড়াল করার, প্রমাণ নষ্ট করার। নইলে রাজ্য প্রশাসন শেষ পর্যন্ত এনআইএ তদন্তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে কেন?”
আর সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের অভিযোগ, “এনআইএ দায়িত্ব পাওয়ার পরে এমন করা রাজ্য পুলিশের উচিত হয়নি। ঘটনাস্থল থেকে এ ভাবে কোনও জিনিস বের করে আনা দেখে মনে হচ্ছে, এটা প্রমাণ লোপাটের জন্য করা হয়েছে।” তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি স্বপন দেবনাথ অবশ্য বলেন, “এ ব্যাপারে কিছু জানা নেই। তাই মন্তব্য করতে পারব না।”
সিআইডি বা রাজ্য পুলিশ অবশ্য এনআইএ-কে তদন্তে বাধা দেওয়া বা তদন্ত প্রভাবিত করার অভিযোগ মানতে চায়নি। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “এনআইএ এলাকায় আসার আগে পর্যন্ত তদন্তের দায়ভার সিআইডি-র। কেস ডায়েরি হস্তান্তর না-হওয়া পর্যন্ত সিআইডি ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতেই পারে। সে ক্ষেত্রে আইন ভাঙা হয় না। এটা তদন্তের প্রক্রিয়া।” এনআইএ তদন্তের রাশ হাতে নেওয়ার মুহূর্তে এই পদক্ষেপ করা কি নিতান্ত প্রয়োজন ছিল? এ বার ওই কর্তা আর জবাব দেননি। এই অবস্থায় ঘটনাপ্রবাহের উপরে নজর রাখছে এনআইএ। তাদের এক কর্তা বলেন, “প্রয়োজনে আইনানুগ পদক্ষেপ করা হবে।”
খাগড়াগড়ে এ দিন রাজ্য পুলিশ ও গোয়েন্দাদের তৎপরতা অনেককেই সারদা-কাণ্ডের একটি পর্বের কথা মনে করিয়েছে অনেককে। চলতি বছরের এপ্রিলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী পিয়ালি সেনের একটি লকার খোলা নিয়ে পুলিশ এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর টানাপড়েন শুরু হয়। সারদা মামলা দীর্ঘদিন চললেও বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ দীর্ঘদিন ওই ব্যাঙ্কের লকার খোলার ব্যবস্থা করেনি। অথচ, ইডি লকারটি বাজেয়াপ্ত করে চলেছে বলে খবর পেয়ে তড়িঘড়ি লকারটি খোলা হয়।
সে কথা মনে করিয়ে রাজ্য পুলিশের একাধিক প্রাক্তন কর্তার বক্তব্য, “তদন্তের দায়িত্ব হস্তান্তরের দিনেই এই তৎপরতার অন্য ব্যাখ্যাও করা সম্ভব। এত দিন তা হলে কি কোনও তদন্তই করেনিজেলা পুলিশ বা সিআইডি?” তাঁরা মনে করছেন, “শেষ মুহূর্তে এ ভাবে নমুনা সংগ্রহ করা হলে কেউ মনে করতেই পারেন, এনআইএ আসার আগে ঘটনাস্থল প্রায় লেপাপোছা করে দেওয়া হচ্ছে। যাতে এনআইএ-র হাতে প্রায় কিছুই না আসে।”
বর্ধমান-কাণ্ডে রাজ্য সরকারের ভূমিকা এবং শাসক দলের যোগসাজশের অভিযোগ নিয়ে আজ, শনিবার বর্ধমানে মিছিল করে পুলিশ সুপারের দফতর ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছে যুব কংগ্রেস। বিধায়ক-দল নিয়ে মিছিলের পরে কার্জন গেটে কংগ্রেসের সভা হবে ১৫ অক্টোবর। বর্ধমান-কাণ্ডের জেরেই সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের প্রতিবাদে কলকাতায় বামফ্রন্টের মিছিল সোমবার। সিপিএমের কৃষকসভাও এ দিন জানিয়েছে, ১৫ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত জেলায় জেলায় তাদের জাঠায় বর্ধমানের ঘটনার প্রতিবাদও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
—নিজস্ব চিত্র
(সহ প্রতিবেদন: শুভাশিস ঘটক)
No comments:
Post a Comment