অপমানিতরাই হাতে পেলেন বর্ধমানের ভার
নিজস্ব সংবাদদাতা (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
কলকাতা, ১১ অক্টোবর, ২০১৪
সাত দিন আগের অভিজ্ঞতা একেবারেই সুখকর হয়নি। এখন তারাই তদন্তের দায়িত্বে! খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডের তদন্তভার সরকারি ভাবে শুক্রবার হাতে পেয়ে তাদের দগদগে ঘায়ে মলম পড়ল বলে মনে করছে এনআইএ। বিস্ফোরণের এক দিন পরে, ৩ অক্টোবর বেলা ১১টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) দুই অফিসার। অভিযোগ, ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁরা যে শুধু রাজ্য পুলিশের অসহযোগিতার মুখে পড়েছিলেন, তা-ই নয়। উল্টে ওই দিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দুই অফিসারের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়েছিল যেন তাঁরা রবাহুত এবং ঘটনাস্থল থেকে যাবতীয় প্রমাণ ও নথিপত্র সব ঘেঁটে দিয়ে তদন্তের ক্ষতি করতে এসেছেন! অভিযোগ উঠেছে, দোতলার যে ঘরে বিস্ফোরণ হয়, তার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা এনআইএ-র অফিসারদের শুনিয়ে সিআইডি-র এক বর্ষীয়ান অফিসার তাঁর সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “এখনই দরজায় তালা দিয়ে দে। বাইরের আজেবাজে লোক যেন ঢুকতে না পারে!”
এনআইএ সূত্রের খবর, গাঁধী জয়ন্তীর দুপুরে ওই বিস্ফোরণে দু’জনের প্রাণহানির খবর বিকেলে নিজস্ব সূত্রেই পেয়ে যায় তারা। এবং তার পর ঘটনার সঙ্গে জেহাদি সন্ত্রাসবাদের যোগ থাকার ইঙ্গিত ওই রাতেই কয়েক জন সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরে পরের দিন বর্ধমানে অনুসন্ধানকারী দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় দিল্লির জয় সিংহ রোডে এনআইএ-র সদর দফতর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খবর, হায়দরাবাদ, কোচি, লখনউ, মুম্বই ও গুয়াহাটিতে এনআইএ-এর শাখা অফিস রয়েছে। কলকাতায় তাদের এক জন এসপি-র নেতৃত্বে পাঁচ জনের একটি দল সল্টলেকে অস্থায়ী আস্তানা তৈরি করে কাজ করে ঠিকই, কিন্তু এই শহরে তাদের পুরোদস্তুর কোনও শাখা অফিস তৈরি হয়নি। অফিস গড়ার জন্য কোনও স্থায়ী জায়গাও মেলেনি এখনও পর্যন্ত। এই কারণে কলকাতায় এনআইএ-র পূর্ণাত্রার শাখা অফিস না থাকলেও কলকাতাকে কেন্দ্র করেই ওই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি ইউনিট পূর্ব ভারতে কাজ করে।
ওই কর্তা জানান, কলকাতায় এনআইএ-র অস্থায়ী ইউনিটই গত বছর পটনার গাঁধী ময়দানে নরেন্দ্র মোদীর সভাস্থলে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ, পটনা স্টেশনে বিস্ফোরণ এবং বুদ্ধগয়ায় ধারাবাহিক বিস্ফোরণের তদন্তে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে।
এনআইএ সূত্রের খবর, কলকাতা ইউনিটেরই এক জন ডিএসপি ও এক জন ইনস্পেক্টরকে এসপি বিক্রম খালাটে ৩ অক্টোবর ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে জানান, এই ব্যাপারে রাজ্য পুলিশকে যাবতীয় সহযোগিতা করতে হবে। কিন্তু এনআইএ-র দুই অফিসার কলকাতা থেকে খাগড়াগড়ের ঘটনাস্থলে গিয়ে আবিষ্কার করেন, রাজ্য পুলিশ তথা সিআইডি তাঁদের সহযোগিতা নিতেই প্রস্তুত নয়! এমনকী এনআইএ ঘটনাস্থলে কেন এল, না ডাকা সত্ত্বেও কেন নিজে থেকে এল, তা নিয়েও রাজ্য পুলিশের কয়েক জন অফিসার প্রশ্ন তোলেন বলে অভিযোগ। এনআইএ-র দাবি, জেলা পুলিশের কোনও কোনও অফিসার যুক্তি দেন, ‘অন্য কেউ’ ঢুকলে ‘ক্রাইম সিন’ নষ্ট হতে পারে, অর্থাৎ ঘটনাস্থলের তথ্যপ্রমাণ চৌপাট হয়ে যেতে পারে!
জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার এক কর্তার কথায়, “আমাদের দুই অফিসারের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হয়েছিল যে, তাঁরা যেন পুলিশ বা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কেউ নন, বাইরের লোক!” এনআইএ-র অভিযোগ, বর্ধমানের পুলিশ সুপারকে বার বার মোবাইলে ফোন করা হলেও তা বেজেই গিয়েছিল। যদিও এসপি সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা আগেই দাবি করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেননি।
শেষমেশ এনআইএ থেকে রাজ্য পুলিশের আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এনআইএ-র দাবি, আইজি আশ্বাস দেন, কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা (সিএফএসএল) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার ওই দুই অফিসার ঘটনাস্থলে ঢুকতে পারবেন। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। উল্টে সিআইডি-র এক বর্ষীয়ান অফিসার প্রকারান্তরে ওই দুই অফিসারকে ‘বাইরের আজেবাজে লোক’ বলে উল্লেখ করেন, এমনই অভিযোগ এনআইএ-র।
ঘটনাস্থলে ঢুকতে না পেরে দুপুরে এনআইএ-র অফিসারেরা যান বর্ধমান থানায়। সেখানে আলিমা বিবির সঙ্গে মিনিট দশেক কথা বলা ও ঘটনাস্থল থেকে বাজেয়াপ্ত সামগ্রী এক ঝলক দেখার সুযোগ পান তাঁরা। ঘণ্টা খানেক পর এনআইএ-র দুই অফিসার বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে জখম আব্দুল হাকিমের সঙ্গেও কথা বলেন। সে দিন সন্ধে ৬টা নাগাদ এনআইএ-র দুই সদস্যের দলটি ফিরে আসে কলকাতায়।
পরের দিন, ৪ অক্টোবর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে রিপোর্ট দিয়ে এনআইএ অভিযোগ করে, রাজ্য পুলিশ তাদের সঙ্গে অসহযোগিতা করেছে, অথচ খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত।
তার পর সাত দিন কেটে গিয়েছে। মূলত এনআইএ-এর অভিযোগকে মান্যতা দিতেই তাদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। দায়িত্ব পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাজে নেমেও পড়েছে এনআইএ।
No comments:
Post a Comment