স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশের উপরে এখনও আস্থা রাখতে পারছেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে কুর্সিতে বসেছেন তিন বছর আগে। তার পরেও নিজের নিরাপত্তায় রাজ্য বা কলকাতা পুলিশের পরিবর্তে মমতার পছন্দ রেলরক্ষী বাহিনী (আরপিএফ)-র অফিসার-জওয়ানেরা, যাঁরা কিনা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন যেমন তাঁর সুরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন, তেমন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথের দিন থেকেও তাঁকে ঘিরে রেখেছেন। এবং এখনও নিজের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে সেই রেলরক্ষীদেরই ফের বহাল রাখতে চাইছেন মমতা।
নবান্নের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর মূল নিরাপত্তার ভারপ্রাপ্ত আরপিএফের ন’জন অফিসার-জওয়ানের পশ্চিমবঙ্গে ডেপুটেশনের মেয়াদ ফুরোচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে। কিন্তু মমতা চাইছেন, রেলরক্ষীরাই তাঁর নিরাপত্তা দেখুন। তাই মমতার ব্যক্তিগত সুরক্ষা-বলয়ের রেলরক্ষীদের কার্যকালের মেয়াদ বাড়াতে দিল্লিতে মোদী সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে মমতারই হাতে থাকা রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর। আরপিএফের ডিজি কৃষ্ণ চৌধুরী বৃহস্পতিবার হায়দরাবাদ থেকে টেলিফোনে বলেন, “রাজ্যের আবেদন হাতে এলে রেলের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
যদিও আরপিএফ সূত্রের ইঙ্গিত, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এমন আর্জি পেশ করলে তা নামঞ্জুরও হতে পারে। কারণ, দেশের অন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সুরক্ষায় রেলরক্ষী নিয়োগ করা হয়নি। সচরাচর হয়ও না। কিন্তু মমতার ক্ষেত্রে হয়েছে, কারণ রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতার নিরাপত্তায় যাঁরা ছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি তাঁদেরই বহাল রেখেছিলেন। আর তৃণমূলের সমর্থনপুষ্ট কেন্দ্রের তদানীন্তন ইউপিএ সরকার তাতে আপত্তি করেনি।
ঘটনা হল, বিরোধীরা তো বটেই, আদালত থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও গত তিন বছরে বিভিন্ন ঘটনায় রাজ্যের পুলিশকে বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। অভিযোগ, মমতার পুলিশ শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে চলছে। চুরি-ছিনতাই হোক বা সিন্ডিকেটের গণ্ডগোল, নারী নির্যাতন হোক বা প্রকাশ্যে কটূক্তি বিভিন্ন কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, শাসকদলের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদের মুখে খুন-ধর্ষণের হুমকি শুনেও কার্যত নিধিরাম হয়ে থেকেছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ। যার উপরে আস্থা হারিয়ে আদালত কিছু অপরাধের তদন্তভার তুলে দিয়েছে সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। অতি সম্প্রতি ভাঙড়, খাগড়াগড়, পাড়ুই বা মাখড়ার ঘটনাবলি রাজ্য পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে সংশয় আরও প্রকট করে তুলেছে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও নিজের পুলিশের সামান্য সমালোচনাও শোনা যায়নি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। উল্টে সমালোচকদের গায়ে কোনও না কোনও ‘তকমা’ লাগিয়ে তিনি পুলিশের পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তাঁর পুলিশ যদি এতই দক্ষ হয়, তা হলে নিজের নিরাপত্তার জন্য কেন তাদের উপরে মুখ্যমন্ত্রী ভরসা রাখতে পারছেন না? রাজ্যপাট চালানোর তিন বছর বাদেও কেন তাঁর আরপিএফ-কেই লাগছে?
বস্তুত নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসা ইস্তক কেন্দ্রের সঙ্গে মমতা সরকারের সম্পর্ক এতটাই ‘মধুর’ যে, মুখ্যমন্ত্রী এখনও দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। রাজধানীতে প্রধানমন্ত্রীর ডাকা কোনও বৈঠকেও হাজির হননি। অন্য দিকে রাজ্যের ‘স্বাধীনতায়’ কেন্দ্রের ‘প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ’ নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন। এমনকী, খাগড়াগড়-কাণ্ডে এনআইএ-তদন্তকেও ‘ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। নিজের নিরাপত্তায় সেই কেন্দ্রীয় সরকারেরই অধীনস্থ রেলরক্ষী বাহিনীর উপরে তাঁর এ হেন আস্থাও যথেষ্ট বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে। রাজ্য প্রশাসনের কী অভিমত?
রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে গোড়ার দিকে আরপিএফের জনা তিরিশেক জওয়ান ও অফিসারকে তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োগ করা হয়। তখন রেলমন্ত্রী তৃণমূলের দীনেশ ত্রিবেদী। মমতার সর্বক্ষণের নিরাপত্তা ছাড়াও কালীঘাটের বাড়ি প্রহরার ভারও রেলরক্ষীর উপরে ন্যস্ত হয়। মমতা পরে ৯ জনকে (এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট সিকিওরিটি কমিশনার, তিন জন হেড কনস্টেবল, পাঁচ জন কনস্টেবল) রেখে বাকিদের ছেড়ে দেন। “এই ন’জনের সঙ্গে গত তিন বছরে মুখ্যমন্ত্রীর ভাল রকম বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে। তাই ডেপুটেশনের মেয়াদ ফুরোলেও ওঁদেরই তিনি রাখতে চাইছেন।” ব্যাখ্যা এক স্বরাষ্ট্র-আধিকারিকের।
নবান্ন-সূত্রের খবর: রাজ্যের নিরাপত্তা-অধিকর্তা বীরেন্দ্র গত ১৩ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি নোট পেশ করেন। তাতে বলা হয়েছে, “ভিআইপি’র (অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী) সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ওঁকে জানিয়েই ফের রেলরক্ষীদের বহাল রাখার আর্জি পাঠানো হল। সংশ্লিষ্ট রেলরক্ষীদেরও মত নেওয়া হয়েছে।” এক শীর্ষ স্বরাষ্ট্র-কর্তার কথায়, “নিরাপত্তা-অধিকর্তার প্রস্তাব অনুযায়ী রেল মন্ত্রকে আর্জি জানানো হয়েছে। তবে সেখানে ওঁদের ডেপুটেশনের মেয়াদবৃদ্ধির সময়সীমা চাওয়া হয়নি। তা মন্ত্রকের বিবেচনার উপরে ছাড়া হয়েছে।” আরপিএফের তথ্য বলছে, রেল থেকে রাজ্যে ডেপুটেশনে গেলে তিন বছর বাদে ফিরতে হয়। এটাই নিয়ম। ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে মেয়াদ দু’বছর বাড়তে পারে।
এখন প্রশ্ন, মমতা-রক্ষায় রেলরক্ষী বহাল রাখার প্রস্তাবটিকে নরেন্দ্র মোদী সরকার কি ‘ব্যতিক্রমী’ ধরবে? আরপিএফের এক কর্তার মতে, সাধারণত এমন ক্ষেত্রে মেয়াদবৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। আর একটা ব্যাপারও আছে। রেলরক্ষী নেওয়া হলে তার খরচ সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বহন করার কথা। অথচ গত তিন বছর ধরে মমতার সরকার সেই টাকা বাকি ফেলেছে বলে বাহিনীর অভিযোগ। প্রশাসন-সূত্রের বক্তব্য, ডেপুটেশনে আসা ন’জনের বেতন রাজ্যই দিচ্ছে। এর বাইরে কত বকেয়া,তাঁদের জানা নেই।

নিরাপত্তা বলয়ে মুখ্যমন্ত্রী। গঙ্গাসাগরে দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি।
নবান্নের খবর: রাজ্যে ভিভিআইপি-সুরক্ষা বাবদ খরচের বহর গত তিন বছরে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী-সহ ভিভিআইপি’দের নিরাপত্তার ভার সিকিউরিটি ডিরেক্টরেটের, যার পোশাকি নাম স্পেশ্যাল সিকিওরিটি উইং (এসএসডব্লিউ)। এখানে শ’পাঁচেক অফিসার-কর্মী রয়েছেন। ২০১১-১২ সালে উইংয়ের পিছনে বার্ষিক খরচ ছিল পাঁচ কোটি টাকা। চলতি বাজেট বরাদ্দে বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৬ কোটি। যার মধ্যে শুধু নিরাপত্তাকর্মীদের যাতায়াত বাবদই প্রায় ৫ কোটি। মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফরের আগে ‘গোয়েন্দা তথ্য’ সংগ্রহের জন্য তিন কোটি। হাতিয়ার-সরঞ্জাম খাতেও ফি বছর মোটা টাকা বরাদ্দ।
যে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা খাতে এমন ঢালাও ব্যয় বরাদ্দ, তাঁকে সুরক্ষা দিতে আরপিএফ লাগবে কেন, সেই প্রশ্নটা থাকছেই। যার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা প্রশাসনের তরফে মেলেনি। এ বিষয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে ফোন করা হয়। ডিজি ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি।