সন্তোষপুর
আক্রান্ত পুলিশ, অভিযুক্ত শাসক দলের কাউন্সিলর
নিজস্ব সংবাদদাতা (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
২৯ অক্টোবর, ২০১৪,
সেই সার্জেন্ট সুকান্ত মুহুরি।
এ বার খাস কলকাতাতেই আক্রান্ত হল পুলিশ। এক দিনের ব্যবধানে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে শহরে দু’বার আক্রমণের মুখে পড়তে হল তাদের। মঙ্গলবার দুপুরে যাদবপুরের সন্তোষপুরে এবং রবিবার রাতে লেক এলাকার গোবিন্দপুর কলোনিতে এই দু’টি ঘটনায় মোট চার জন পুলিশকর্মী জখম হন। সন্তোষপুরের ঘটনায় পুলিশের উপরে হামলায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক তৃণমূলের কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, কর্তব্যরত এক সার্জেন্টের সঙ্গে বচসার জেরে তাঁর উপর চড়াও হন তিনি।
সন্তোষপুরের লেকপল্লিতে ঘটনার সূত্রপাত এক ট্যাক্সিচালককে ‘কেস’ দেওয়াকে কেন্দ্র করে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন দুপুর একটা নাগাদ এক ট্যাক্সিচালক সন্তোষপুরের রাস্তায় নো-পার্কিং জোনে ট্যাক্সি দাঁড় করালে কর্তব্যরত সার্জেন্ট মানবেন্দ্র বিশ্বাস তাঁকে ‘কেস’ দিতে যান। ট্যাক্সিচালক তখন ওই সার্জেন্টকে কোনও ‘কেস’ না দিয়ে ‘স্পট ফাইন’ করার অনুরোধ করেন। অনুরোধ মেনে তাঁকে জরিমানা করেন সার্জেন্ট।
পুলিশের একাংশের অভিযোগ, ওই সময়ে ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সঞ্জয় দাস। ট্যাক্সিচালককে কেস দেওয়া নিয়ে মানবেন্দ্রবাবুর সঙ্গে বচসা বাধে তাঁর। মানবেন্দ্রবাবুর সঙ্গী আর এক সার্জেন্ট সুকান্ত মুহুরি সেই সময়ে মোবাইলে ওই বচসার ছবি তুলতে গেলে সঞ্জয়বাবু ও তাঁর সহযোগীরা মোবাইল কেড়ে নিয়ে তাঁর উপরে চড়াও হন বলে অভিযোগ। তখনই ধাক্কাধাক্কিতে মাটিতে পড়ে যান সুকান্তবাবু। পুলিশ সূত্রে খবর, সুকান্তবাবুকে বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর বুকে এবং মাথায় চোট লেগেছে বলে চিকিৎসকেরা পুলিশকে জানিয়েছেন। যদিও বিষয়টি নিয়ে ওই দুই সার্জেন্টের কেউই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে রাজি হননি।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, রাতে সার্ভে পার্ক থানায় ওই কাউন্সিলর এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন মানবেন্দ্রবাবু। তার ভিত্তিতে সরকারি কর্মীর কাজে বাধাদান, তাঁর উপরে হামলা চালানো, হুমকি দেওয়া এবং ভয় দেখানোর মামলা রুজু করেছে পুলিশ। রাতে লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “ওই সার্জেন্টের অভিযোগের ভিত্তিতে কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে। তদন্তও শুরু হয়েছে।” তবে পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ঘটনার কথা প্রথমে চেপে যাওয়া হয়েছিল। ঘটনার ছ’ঘণ্টারও বেশি সময় পরে এ নিয়ে এফআইআর দায়ের করা হয়।
তবে বিষয়টি নিয়ে অভিযুক্ত কাউন্সিলর সঞ্জয়বাবুর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর মোবাইল বেজে যায়। এসএমএসেরও জবাব মেলেনি।
অন্য দিকে, রবিবার রাতে কালীপ্রতিমা বিসর্জনের সময়ে বাজি ফাটানো নিয়ে দুই ক্লাবের সংঘর্ষ হয়। তা আটকাতে গিয়ে মার খায় পুলিশ। পুলিশের অভিযোগ, তাদের লক্ষ করে ইট, পাথর, বাজি ছোড়া হয়। এতে জখম হন তিন পুলিশকর্মী। ঘটনাটি ঘটেছে লেক থানার গোবিন্দপুর লেনে।
পুলিশ সূত্রের খবর, ওই রাতে বিসর্জন সেরে এলাকায় ফিরছিলেন স্থানীয় একটি ক্লাবের সদস্যেরা। মাঝরাস্তায় যোধপুর পার্কের একটি ক্লাবের শোভাযাত্রার মুখোমুখি হন তাঁরা। পুলিশ জানায়, যোধপুর পার্কের ওই ক্লাবটির সদস্যেরা অন্য ক্লাবটির সদস্যদের লক্ষ করে বাজি ছোড়ে। এর জেরে দু’পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় লেক থানার চার পুলিশকর্মীর একটি দল। পুলিশ জানিয়েছে, সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে পুলিশকে লক্ষ করেও ইট, পাথর, বাজি ছোড়া হয়। ঘটনায় তিন পুলিশকর্মী জখম হন। এই ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি বলে জানায় পুলিশ।
পুলিশ নিগ্রহ: কেউ সাজা পায় কেউ পায় না
নিজস্ব সংবাদদাতা (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
৩০ অক্টোবর, ২০১৪,
একই আইন এবং একই অভিযোগ। অথচ, দুই ক্ষেত্রে আইনের পৃথক ফল।
মঙ্গলবার সকালে সার্ভে পার্কে এক তৃণমূল কাউন্সিলরের নেতৃত্বে আক্রান্ত হয়েছিলেন কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট। সার্ভে পার্কের ঘটনায় রাতে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হলেও বুধবার রাত পর্যন্ত অভিযুক্ত ওই কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। আইনের ভিন্নতা দেখা গেল এই ঘটনার ১১ ঘণ্টা পরে। পুলিশ জানিয়েছে, একই দিনে রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ দুই পুলিশকর্মীকে মারধর করেন এক ব্যক্তি। আর এই ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। ধৃতের নাম নিরঞ্জন চৌধুরী। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার সময়ে মত্ত অবস্থায় ছিলেন তিনি।
কিন্তু একই ধরনের ঘটনায় ভিন্ন আইন কেন? এই নিয়ে বুধবার যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্রকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “ফৌজদারি আইনে সব সময়ে গ্রেফতার বাধ্যতামূলক নয়। ঘটনার পরিস্থিতি বিচার করে গ্রেফতার করা হয়। এই ক্ষেত্রে তদন্ত চলছে।”
স্থানীয় সূত্রে খবর, মঙ্গলবার দুপুর একটা নাগাদ নিয়ম ভাঙার অভিযোগে এক ট্যাক্সিচালককে ‘কেস’ দিতে গিয়ে আক্রান্ত হন পূর্ব যাদবপুর ট্রাফিক গার্ডের এক সার্জেন্ট। সন্তোষপুর এলাকার লেকপল্লিতে ঘটনাটি ঘটে। পুলিশের উপরে আক্রমণের সময়ে ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সঞ্জয় দাস নেতৃত্ব দেন বলেও অভিযোগ। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ঘটনায় সার্জেন্ট সুকান্ত মুহুরি জখম হন। তাঁর বাইক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানবেন্দ্র বিশ্বাস নামে আর এক সার্জেন্টের মোবাইল ফোনটি ভেঙে ফেলারও চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ। প্রথমে বিষয়টি নিয়ে পুলিশ মহলে কেউ কিছু বলতে না চাইলেও পরে রাতের দিকে তৃণমূল কাউন্সিলর সঞ্জয় দাসের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়। অথচ সেই ঘটনায় এখনও অভিযুক্ত কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করা হয়নি।
কী ঘটেছে হরিদেবপুরে? পুলিশ জানায়, ওই রাতে নিরঞ্জনবাবু হরিদেবপুর থানার এক কনস্টেবলের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলে আসেন আরএফএসের কয়েক জন কর্তব্যরত পুলিশকর্মী। মত্ত অবস্থার নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গে তাঁরাও বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
পুলিশ জানিয়েছে, এর পরেই মত্ত ওই ব্যক্তি আচমকা তাঁদের মারধর করতে শুরু করেন। ঘটনায় দুই পুলিশকর্মী অল্পবিস্তর জখম হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার পরেই পুলিশকে মারধরের অভিযোগে নিরঞ্জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, দু’টি ঘটনাতেই কর্তব্যরত অবস্থায় পুলিশের উপরে হামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৩৫৩ ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে হুমকি (৫০৬), ৫০ টাকা মূল্যের বেশি সম্পত্তি ধ্বংস (৪২৭) এবং সমবেত হামলার (৩৪) ধারাগুলি। পুলিশ জানিয়েছে, আইনের অন্য ধারাগুলি জামিনযোগ্য অপরাধ হলেও ৩৫৩ ধারাটি জামিন-অযোগ্য। এই ধারায় অভিযুক্তের দুই বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা দু’টো সাজাই হতে পারে। অথচ অভিযোগ, অভিযুক্ত ওই তৃণমূল কাউন্সিলরকে গ্রেফতার তো দূর অস্ত্, জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করা হয়নি। দুই ক্ষেত্রে দু’রকমের ব্যবস্থা নেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। পুলিশের একাংশের বক্তব্য, এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত এক জন তৃণমূল কাউন্সিলর হওয়ার কারণেই এমন ঘটেছে। তাঁকে গ্রেফতার করতে হলে উপরমহল থেকে অনুমতির প্রয়োজন।
No comments:
Post a Comment