সারদা সংক্রান্ত বিভিন্ন নথি বিধাননগর কমিশনারেট নষ্ট করছে বলে অনেক দিন ধরেই অভিযোগ উঠেছে। গ্রেফতার হওয়া রাজ্যসভা সাংসদ কুণাল ঘোষ এই অভিযোগ আগেও তুলেছেন। সিবিআই সূত্রের খবর, গত বছর এপ্রিলে সুদীপ্ত যখন ফেরার হন, তখন তিনি ভিন্ রাজ্য থেকে আমরিন আরাকে ফোন করে সমস্ত গোপন নথি সরিয়ে দিতে বলেন। আমরিন এতে ভয় পেয়ে যান। তিনি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কাছে যেতে পারেননি। বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ তদন্তে নেমে আমরিন আরার নাম জানতে পারে। পরে সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে আমরিনকে নিয়ে তল্লাশি চালানোর সময়ে ওই সমস্ত পেনড্রাইভ ও সিডি-সহ বিভিন্ন নথির হদিস মেলে। আমরিনই সেগুলি বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশের হাতে তুলে দেন বলে সিবিআই জেনেছে। বিধাননগর কমিশনারেটের এক কর্তা অবশ্য এ দিন বলেন, “আমরা যা বাজেয়াপ্ত করেছি, সেগুলি সবই সিজার লিস্টে রয়েছে।” ঘটনা হল, ওই সমস্ত পেন ড্রাইভ ও সিডি-র উল্লেখ কিন্তু সিজার লিস্টে নেই বলে সিবিআই জেনেছে।
সারদা তদন্তে পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও তদন্তের জাল ক্রমশ গুটিয়ে আনছে সিবিআই। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, কলকাতা ময়দানের একটি ক্লাবের প্রয়াত এক কর্মকর্তার মেয়ে-জামাই থাকেন মুম্বইয়ে। নিতুর সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা তো বটেই, এক রকম পারিবারিক সম্পর্কও রয়েছে বলা চলে। প্রয়াত ক্লাবকর্তার জামাইয়ের ব্যবসার জন্য নিতু তাঁর কাছ থেকে ‘ধমকে-চমকে’ সাত-আট কোটি টাকা আদায় করেছিলেন বলে সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে দাবি করেছিলেন সুদীপ্ত। তদন্তে নেমে এই ব্যাপারে কিছু তথ্য সিবিআইয়ের হাতে এসেছে। অথচ নিতুকে বার বার জিজ্ঞেস করা হলেও তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ তদন্তকারীদের।
সিবিআই সূত্রের খবর, তদন্তকারীদের একটি দল প্রয়াত ক্লাবকর্তার জামাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে মুম্বইয়ে পৌঁছেছে। এই প্রসঙ্গে সুদীপ্ত তাঁর চিঠিতে যশ নামে এক অবাঙালি ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করেছিলেন। প্রয়াত ক্লাবকর্তার জামাইয়ের নাম যশ নয়, তবে তার কাছাকাছি। এবং তিনিও অবাঙালি। তদন্তকারীদের একাংশের আশা, নিতু ও প্রয়াত ক্লাবকর্তার জামাইকে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে রহস্যের জট অনেকটাই খুলবে।
সিবিআইয়ের বক্তব্য, সুদীপ্তর থেকে নেওয়া কোটি কোটি টাকার একটি অংশ নিতু চেকে নিয়েছেন এবং একটি সংস্থার নামেই ওই সমস্ত চেক কাটা হয়েছে। ওই সংস্থাটি কী, তার কাজ কী ধরনের, সারদার টাকা নিয়ে সংস্থাটি কী করেছিল, এই নিয়ে নিতু এখনও কার্যত নীরব বলেই গোয়েন্দাদের দাবি। সুদীপ্তর চিঠির সূত্র ধরে এগিয়ে এ ব্যাপারে কিছু তথ্যপ্রমাণ তদন্তকারীরা হাতে পেয়েছেন। সন্ধির অগ্রবাল নামে নিতু-ঘনিষ্ঠ যে ব্যবসায়ীকে ২৩ অগস্ট সিবিআই গ্রেফতার করেছে, তাঁকে জেরা করেও সুদীপ্তর কাছ থেকে নিতুর জবরদস্তি টাকা আদায়ের ব্যাপারে বহু তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে সিবিআইয়ের দাবি। 
সারদা মামলায় এ দিন সুদীপ্ত ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়-সহ ছ’জনকে আলিপুর আদালতে হাজির করানো হয়। কুণাল ঘোষ অসুস্থ থাকায় হাজির করা যায়নি বলে পুলিশ সূত্রের খবর। নিতু ছাড়া বাকিদের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন অতিরিক্ত বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট হারাধন মুখোপাধ্যায়।
এ দিন বিধাননগরের সিজিও কমপ্লেক্সে প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ব্যবসায়ী, গৌতম বিশ্বাসকে ডেকে জেরা করে সিবিআই। তদন্তকারীরা জেনেছেন, ওই ব্যক্তিই সুদীপ্ত সেনকে মিডিয়া ব্যবসায় আনেন এবং তাঁর মাধ্যমেই একটি চ্যানেলে মোটা টাকা লগ্নি করেন সারদা-কর্তা। সেটা ২০১০ সালের গোড়ার দিক। তখনও সারদার দু’টি দৈনিক বেরোয়নি। তবে সিবিআইয়ের বক্তব্য, গৌতমকে এ দিন ডাকা হয়েছিল অন্য কারণে।
কী সেটা?
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, মোহনবাগান ক্লাবের শতবর্ষ উপলক্ষে তৈরি একটি ছবির মিডিয়া পার্টনার ছিল একটি বাংলা দৈনিক। তবে আসলে সুদীপ্ত সেন-ই টাকা ঢেলেছিলেন। গৌতমবাবু ছিলেন ওই ছবির তিন জন প্রযোজকের অন্যতম। এ দিন ঘণ্টাতিনেক জেরার পরে বাইরে এসে গৌতমবাবু দাবি করেন, ওই ছবির চুক্তি ও আয়ব্যয় সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়। একটি ইংরেজি নিউজ চ্যানেলের এক প্রাক্তন সাংবাদিককেও ডেকে পাঠানো হবে বলে এ দিন সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে। সুদীপ্ত তাঁর চিঠিতে জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তির চাপে তিনি এক কোটিরও বেশি টাকা একটি নতুন চ্যানেল করার জন্য ঢেলেছিলেন।
সারদা-তদন্তের অগ্রগতি প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “যদি সিবিআইকে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে দেওয়া হয়, তা হলে তৃণমূলের পলিটব্যুরোকে আগামী দিনে জেলে রাজনীতি করতে হবে!” তাঁর বক্তব্য, এমন অনেককে সিবিআই ডাকছে বা জিজ্ঞাসাবাদ করছে, যাঁদের শ্যামল সেন কমিশন ডাকেনি। রাজ্য প্রশাসনের সিটও প্রতি পদে অসহযোগিতা করেছিল। এর পরেও সিবিআই যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে আশা হারানোর কিছু নেই বলে অধীর মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বলেন, “সিটের সঙ্গে সিবিআই তদন্তের গুণগত তফাৎ দেখা যাচ্ছে। তদন্তের গতি এবং ব্যাপকতা আগের চেয়ে বেশি। আমরা চাই, দ্রুত তদন্ত শেষ হোক। টাকা সরানোর সুযোগ কেউ যাতে বেশি না পায়।”