সম্পাদকীয় ১ (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)

প্রীতি উপহার

২৩ অগস্ট, ২০১৪, ০০:০১:০০

মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গাপুর সফরে উপহার হিসাবে বাংলার চাল ইত্যাদি সঙ্গেই লইয়া গিয়াছিলেন। সেই দেশে পৌঁছাইয়া সম্ভবত তাঁহার মনে হইয়াছে, তাহা যথেষ্ট নহে। তিনি তড়িঘড়ি আরও একটি উপহার দিলেন— সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ-এর নামে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চেয়ার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি। উপহার প্রদানের ব্যস্ততায় মুখ্যমন্ত্রী হয়তো ভুলিয়া গিয়াছিলেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, সেখানে একটি নূতন চেয়ার প্রবর্তনের নৈতিক অধিকার তাঁহার নাই। অবশ্য, মুখ্যমন্ত্রী বলিতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্র এমনই সর্বব্যাপী যে, বিশ্ববিদ্যালয়টি যে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ভাবে তাঁহার এক্তিয়ারভুক্ত নহে, এই কথাটি তাঁহার খেয়াল ছিল না। দোষ দেওয়ার উপায় নাই। পশ্চিমবঙ্গে অনিল বিশ্বাস অমর হইয়াছেন। তবে, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কৌটিল্য স্বয়ং এমন কাঁচা কাজ করিতেন বলিয়া প্রত্যয় হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাহারও নামে চেয়ার প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে অনিলবাবু হয়তো সিন্ডিকেট-সেনেটের অনুগত জনের মাধ্যমে প্রস্তাব আনাইয়া যথারীতি কাজটি করিতেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামপন্থীদের নিকট আধিপত্যের মাহাত্ম্য শিখিয়াছেন, সূক্ষ্ম কৌশলগুলি আয়ত্ত করেন নাই। ফলে, তাঁহার দখলদারির চেহারাটি দৃষ্টিকটু রকম মোটা দাগের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ার প্রতিষ্ঠা একটি প্রচলিত রীতি। তাহার দুইটি প্রধান গোত্র আছে। প্রথম, বিশ্ববিদ্যালয় যখন কোনও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে সম্মান জানাইতে, এবং পক্ষান্তরে তাঁহার আলোকে নিজেদের গৌরবান্বিত করিতে চাহে, তখন চেয়ার প্রতিষ্ঠা করা হইয়া থাকে। রবীন্দ্রনাথ হইতে অম্বেডকর, বহু বিশিষ্ট জনের নামেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ার বর্তমান। আবার, কেহ যদি কাহারও স্মৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও বিভাগে একটি চেয়ার প্রতিষ্ঠা করিতে চাহেন, এবং তাহার সম্পূর্ণ আর্থিক দায়ভার বহন করিতে চাহেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেচনাসাপেক্ষে তেমন চেয়ার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বহু দেশই বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন চেয়ার প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকে। লি কুয়ান ইউ-এর নামাঙ্কিত যে চেয়ারের প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রী করিয়াছেন, তাহা দুইটি গোত্রের কোনওটিতেই খাপ খায় না। সিঙ্গাপুরের সরকার এই চেয়ারের প্রস্তাব করে নাই, মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাবটি পাড়িবার পূর্বে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরও এমন কোনও ভাবনা ছিল না। চেয়ারটির ব্যয়ভার সম্ভবত রাজ্য সরকারই বহন করিবে। মুখ্যমন্ত্রীর খামখেয়ালের মূল্য কিঞ্চিৎ অধিক পড়িল। পূর্বে রাজা-মহারাজারা এমন মেডেল বিলাইতেন। সেই রাম নাই, সেই কিষ্কিন্ধাও নাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ট্র্যাডিশনটি ধরিয়া রাখিয়াছেন।
মুখ্যমন্ত্রী যাঁহার নামে চেয়ার ঘোষণা করিয়া দিলেন, সেই লি কুয়ান ইউ-এর রাজনৈতিক দর্শনের সহিত পরিচিত হওয়ার মতো সময় মুখ্যমন্ত্রী পাইয়াছেন বলিয়া প্রত্যয় হয় না। রাজনীতিক এবং প্রশাসক রূপে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতগুলি নীতির প্রতীক, লি কুয়ান ইউ প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই তাহার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন। সিঙ্গাপুর নামক অতি ক্ষুদ্র এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পূর্ণ বঞ্চিত একটি অনগ্রসর ভূখণ্ডকে তিনি একক ভাবে প্রথম বিশ্বের অন্যতম সেরা শহরে পরিণত করিয়াছেন। কঠোর হাতে। তিনি কাজে বিশ্বাসী। পাওয়াইয়া দেওয়ার রাজনীতিতে তাঁহার আন্তরিক অনীহা। তাঁহার শাসনে, এবং পরবর্তী কালের সিঙ্গাপুরেও, রাজনীতি কখনও অর্থনীতির পথে বাধা হয় নাই, বরং অর্থনীতির যাত্রাপথটি মসৃণতর করাই রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য রূপে বিবেচিত হইয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লি কুয়ান ইউ-এর উদাহরণ হইতে শিখিবেন কি? না কি, চেয়ার প্রতিষ্ঠার প্রতীকেই তাঁহার আত্মার আনন্দ, প্রাণের শান্তি?