সম্পাদক সমীপেষু(সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
২৬ অগস্ট, ২০১৪, ০০:০৭:০০
এখানে শিল্প হবে কী করে
দীর্ঘ কর্মজীবনে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বিভিন্ন শিল্পে যুক্ত থাকার সুবাদে এই রাজ্যে যেমন দেখেছি শিল্পের স্বর্ণযুগ, তেমনই দেখেছি জঙ্গি বা হিংস্র ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। সেই সঙ্গে লোকাল সন্ত্রাস ও এক শ্রেণির লোকেদের রোজকার দাদাগিরি এবং জুলুম। ফলে দেখেছি, বহু শিল্প রুগ্ণ হতে হতে ক্লোজার বা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো অন্য রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
আর সেই সুযোগে শিল্পে প্রবেশ ঘটেছে কিছু স্বার্থান্বেষীর, যাদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যই হল, শিল্পকে কঙ্কালসার বা ছিবড়ে করে ছেড়ে দেওয়া। এরা কেউই শিল্পোদ্যোগী বা শিল্পপতি নয়, শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার নামে চিরদিনের মতো শেষ করার কারিগর। তাই রুগ্ণ শিল্প পরিচালনার দায়িত্ব কারও হাতে তুলে দেওয়ার আগে এই কথা আমাদের মাথায় রাখলে ভাল হয়।
শিল্পপতি আমরা তাঁদেরই বলি, যাঁরা বংশানুক্রমিক ভাবে শিল্প বা ইনডাস্ট্রি পরিচালনা করেন বা চালান। এবং যাঁদের মধ্যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শিল্প স্থাপন করে ব্যবসা বাড়ানোর একটা প্রবণতা থাকে। এঁদের কাছে ব্যবসা বাড়ানোটা একটা নেশা, পেশা নয়। এঁরা শিল্পের মর্যাদা যেমন বোঝেন, তেমনই কর্মচারীদের সম্মান দিতেও জানেন। এঁরা কর্মচারীকে কখনওই কর্মচারী হিসাবে ভাবেন না, সহকর্মী ভাবেন।
তাই এ হেন শিল্পপতিদের শিল্প স্থাপনের জন্য কোনও রকম অনুরোধ বা উৎসাহিত করতে হয় না। চাহিদা মতো প্রকৃত পরিকাঠামো, সুস্থ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং রাজ্য সরকারের তাৎক্ষণিক সহযোগিতা পেলেই এঁরা বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিজেরাই নিয়ে এগিয়ে আসেন শিল্প স্থাপনের জন্য। তা না-হলে শুধু সরকারি ভর্তুকি বা অনুদান বাড়িয়ে এঁদের শিল্প স্থাপনে আকৃষ্ট করা সম্ভব নয়। এঁরা সকলেই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, প্রতিষ্ঠিত মানুষ। এঁদের কেউ বিদ্রুপ করলে বা এঁরা কোনও কারণে আঘাত পেলে এক বার যদি রাজ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, হাজার অনুনয় বিনয় করলেও সহজে সেই রাজ্যের দিকে ফিরে তাকান না। তার দরকারও হয় না এঁদের, কারণ বহু রাজ্য বা দেশ এঁদের আপ্যায়নের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে বসে আছে।
রতন টাটা এক জন প্রবীণ পোড়খাওয়া স্বনামধন্য বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং দক্ষ প্রশাসক। তাঁর সম্পর্কে যাঁরা ‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে’, ‘ওঁর মতিভ্রম হয়েছে’, ‘উনি রাজনীতি করতে এসেছেন’ ইত্যাদি ইত্যাদি অসম্মানজনক মন্তব্য করেছেন, তাঁদের দ্বারা আর যা-ই হোক, শিল্পোন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
বহু দিন পর ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পোন্নয়নে একটা আশার আলো দেখা গিয়েছিল। যখন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটা এই রাজ্যকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর ন্যানো প্রকল্পের জন্য। সে দিন সেই প্রকল্প ঘিরে শুধু এই রাজ্য নয়, অন্যান্য রাজ্যেও শিল্পপতিদের মধ্যে এই রাজ্যে শিল্প স্থাপনের বিশেষ আগ্রহ লক্ষ করা গিয়েছিল।
সে দিন যদি সত্যিই এই ন্যানো প্রকল্পকে দলমতনির্বিশেষে সাদরে অভ্যর্থনা করে এই রাজ্যে আনা সম্ভব হত, তা হলে আজ হলফ করে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের মানচিত্রটাই বদলে যেত। কিছুটা হলেও পশ্চিমবঙ্গ তার হারানো গৌরব ফিরে পেত।
মাঝে মাঝে মনে হয় রাজনীতিকদের প্রশ্ন করি, আচ্ছা, উন্নয়নের রাজনীতি করা যায় না? মানুষ তো আপনাদের ভোট দেয় বা জেতায় তাদের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য। গুজরাত যদি উন্নয়নের রাজনীতি করে রাজ্যটাকে উন্নয়নের মডেল করে তুলতে পারে এবং ভোটেও জিততে পারে, তা হলে পশ্চিমবঙ্গই বা পারবে না কেন?
মনে হয়, মানুষের ভালমন্দ মানুষকেই এখন বুঝতে হবে। রাজনীতি করার জন্য রাজনীতি বন্ধ করে শুধু উন্নয়নের জন্য রাজনীতি বাধ্যতামূলক হলে তবেই দেশের বা দশের উন্নয়ন সম্ভব।
গোপাল মুখোপাধ্যায়। কলকাতা-৯৭
No comments:
Post a Comment