প্রবন্ধ ২ (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
এ আমার জগের মুলুক
কী জগ-টা ছুড়েছিলাম সেই টিচারটার দিকে! ওঃ, অন্য দেশ হলে আমায় অলিম্পিকে নিয়ে যেত! ইভেন্টের নাম ‘জগিং’!
২ নভেম্বর, ২০১৪, ০০:০০:০০
আরে, জনগণের কথায় পার্টি চলে না কি? জনগণ তো গাধা, না না, গাধা নয়, ভেড়ার পাল, মিডিয়ার ছপ্টির ঘায়ে এক বার এ দিক ঝুঁকছে, এক বার ও দিক। খবরকাগজগুলো হেডলাইন করল, তৃণমূল ভাল, সবাই বলবে হ্যঁা হ্যঁা ভাল। আবার শয়তানগুলো চ্যানেলে বলল তৃণমূল খারাপ, পাবলিক মুড়ি খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিল, সত্যিই খুব খারাপ। এদের আবার কেউ ভয় পায়? ভয় পাওয়ায়। ভোটের দিনকতক আগে থেকে র্যান্ডম চড় মারো লাথি ঝাড়ো বন্দুক নিয়ে টেররাইজ করে রাখো, যারা বিরোধী-মাইন্ডেড তাদের ভোট দিতেই দিয়ো না, মারতে মারতে বুথের দশ মাইল দূরে ফেলে এসো, আর এক্সট্রা ত্যান্ডাইম্যান্ডাই দেখলে, গুড়ুম। মিটে গেল। পার্টির সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক হবে চাবুকের সঙ্গে পাছার সম্পর্ক। কথায় কথায় থ্রেট থাকবে, এক দিন চড়াও হব, ব্যস, কাগজে ডেডবডির কালার-ছবি বেরবে। তা না, সেই জনগণের কাছে কী ইমেজ হচ্ছে, এই ভয়ে আমায় ছ’বচ্ছর সাসপেন্ড করে দিল!
কী জগ-টা ছুড়েছিলাম সেই টিচারটার দিকে! ওঃ, অন্য দেশ হলে আমায় অলিম্পিকে নিয়ে যেত! ইভেন্টের নাম ‘জগিং’! তা ছাড়া, বোম না ছুড়ে জাস্ট জগ ছুড়েছি, সেই জন্যে আমার সংযমের বাহাদুরি দে! জগ খুলে জলও তো ছুড়তে পারতাম! তা হলে মেয়েটার কাপড় ভিজে যেত। কী ইজ্জত-লস হত! তা কিন্তু করিনি। মাথা আমার একদম সাফ। আরে, তাজা ছেলে আমি। আমার মধ্যে একটা তেজ সব সময় রাগী ভাতের হাঁড়ির মতো ফুটছে। এরাই তো পৃথিবীকে চেঞ্জ করে! চ্যালেঞ্জ দেখলে লাফিয়ে পড়ে, পাহাড় দেখলে লং জাম্প দেয়, সমুদ্র দেখলে তার মধ্যে চান করতে করতেই বাথরুম সেরে নেয়। এরা কিচ্ছুকে পরোয়া করে না। পাঙ্গা নিতে এলেই হাতের কাছে যা দেখে স্ট্রেট ছুড়ে মারে। পেপারওয়েট থাকলে ছুড়ব, জগ তো তা-ই সই, কিছু না পেলে একটা টিচারকেই তুলে আর একটা টিচারের দিকে ছুড়ে মারব। এরা ভীম ভাসমান মাইন। ছোটা ভীম নয় কিন্তু।
আগুন নিয়ে খেলা করা এই সব পাবলিকই পার্টিকে জেতায় আর ক্ষমতায় রাখে। সমস্ত পার্টির গুন্ডা থাকে। যে পার্টির গুন্ডা যত নিপুণ নিষ্ঠুর নিরক্ষর, সে পার্টির জোর তত বেশি। কত ন্যাকা লোক খবরকাগজে কী সব হাবিজাবি অ্যনালিসিস করে, কোন দল কেন জিতল। আরে ভাই, কংগ্রেসের আগে ভাল ভাল গুন্ডা ছিল, তার চেয়ে সিপিএমের গুন্ডা বেটার হয়ে গেল, তো ওরা জিতে গেল। তার পর তৃণমূলের গুন্ডা আরও ভাল হল, আমরা জিতে গেলাম। এই তো ব্যাপার। এতে ভাবার কী আছে? অ্যাকচুয়ালি, ভাবাভাবি যত বেশি হবে, জীবনে তত বখেড়া। আরে, পুলিশকে পেটাবার সময়ও আমি আগুপাছু কিচ্ছু ভাবিনি। পড়াশোনা করিনি তো, তাই আমার মাথায় কোনও বাড়তি বস্তা নেই। ফাঁকা খুলিতে চড়াত্ চড়াত্ ইলেকট্রিক খেলছে। যারা আমার মতো হতে চায়, আমাকে পুজো করে, তাদের প্রতি আমার উপদেশ: বেশি ভেবে সময় নষ্ট কোরো না। কাজ করো। মানে, যার ওপর খার উঠবে, সটান মেরে দাও। থানায় ঢুকে আমি তাণ্ডব করেছি। আবার শত্রু-দলের একটা লোক, গলায় গামছা দিয়ে হাঁটে, তাকেও বেধড়ক্কা মেরেছি। ইশকুলে ঢুকে অর্ডার দিয়েছি, পরীক্ষা দিচ্ছে যে ফুলের মতো ছেলেমেয়েগুলো, তাদের টুকলি করতে দিন। তবে তো ওরা আমার মতো হয়ে উঠবে। শেষে কি পড়ায় মন দিয়ে আসল কাজগুলো নেগলেক্ট হবে? আসল কাজ কী? শের হওয়া। শের। গিধ্ধড় নয়। তুমি যেখান দিয়ে হাঁটবে, লোকে সেলাম ঠুকে রাস্তা ছেড়ে পাঁইপাঁই সরে যাবে, থরথরিয়ে কাঁপবে। সে অন্য দলের হোক, আর নিজের দলের। মারামারির সময় কোনও আমরা-ওরা ভেদাভেদ রেখো না। ছিঃ। ভেদ করতে নেই। নিজের দলের লোক ঝামেলি করলে, তাকেও জানে মেরে দেবে। আমার হাতেপায়ে আপনিই এ সব ডিপ থট এসে যায়, তাই তো আমি দামাল। ইংরিজিতে বলে the মাল!
জানি, এই সাহস দেখে বহুত লোকের চোখ টাটায়। হবেই, এটা তো বাঙালি জাতের ল্যান্ড। আর এই জাতটা ম্যাদামারা। সারা দিন শুধু ভয় খায় আর মেয়েছেলের মতো গান গায়। সেখানে এই রকম একটা দাপুটে সিংহম্ হাঁটছে দেখলে, তার পায়ের স্টেপে হুগলি ব্রিজ অবধি কেঁপে ওঠে, কিউবিক্লের ভেতর ক্যাবলাদের হাঁটু লড়বড় করে। আর আছে কয়েকটা শেয়াল পণ্ডিত, সারা দিন পিনপিন প্যানপ্যান করে আঁতেল বক্তিমে মারে, শালাদের কব্জিগুলো সরু আর চেহারা সিড়িঙ্গে, মদমাংস দেখলে পালায় আর বাড়ি থেকে টিপিনকারি খুলে ঢ্যঁাড়সের ঝোল খায়, আর হাত নেড়ে নেড়ে শক্ত বাংলা ওয়ার্ড বলে। এই গরমকালে মাফলার জড়ানো ব্যাটারাই যত আলফাল আইডিয়া ঢোকাচ্ছে পার্টির মগজে। আরে, একটা মারমুখো থাবা-রেডি মেম্বার থাকলে লোকে সেই দলকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করে রে! বিজেপি এখন সারা বাংলায় কন্ট্রোল নিতে চাইছে, আমি আছি জানলে ওরা কোথাও ঢোকার আগে দশ বার ভাববে। আমাকে সাসপেন্ড করে কার পিঠ-চাপড়ানি পাবি? বড়জোর বিরোধী দলগুলোর, যারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে, সচিন তেন্ডুলকরকে ড্রেসিং রুমে রেখে এই বোকা দলটা খেলতে নামছে বলে।
আবার ছ’বছর! রাম তবু চোদ্দো বছর বনবাসে ছিল, তার একটা ওয়েট আছে, ডবল ফিগার। ছ’বছরটা কোত্থেকে এল? আমি থোড়াই অদ্দিন বসে থাকব! অন্য পার্টি জয়েন, বা ফ্রিল্যান্সও করতে পারি। মোটা ফি নিয়ে এমন ভাঙচুর, বৈদিক যুগের রুইন! আবার কে বলতে পারে, আমার কাঁদোকাঁদো ক্ষমাচিঠি (ট্যাকটিক্স, বস) দেখে লিডাররা অ্যায়সা ফোঁপাল, ফের বহাল হয়ে গেলাম। সেই ঘোটালায় কেউ সাহস করে আসলি কোশ্চেনও বাগিয়ে ফেলতে পারে: আমাকে বাদ দিলে, পার্টি ছ’বচ্ছর টিকবে তো?
লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়
**************
সম্পাদকীয় ২ (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
দেখিয়া যেমন মনে হয়, অনেক কিছুই আসলে তেমন নহে। যুগযুগান্তর ধরিয়া মানুষ এই সতর্কবাণী শুনিয়াছে এবং ভুলিয়াছে। অথচ বাহিরের চাকচিক্য অথবা আস্ফালনে বিভ্রান্ত না হইয়া মন দিয়া দেখিলে এবং বিচার করিলেই মলাট খুলিয়া সত্য প্রকাশ হয়। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁহার চালচলন দর্শন করিলে এবং কথাবার্তা শ্রবণ করিলে এই বিশ্বাস জন্মাইতে বাধ্য যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুল্য প্রবল নেতা নরেন্দ্র মোদীর ভারতেও খুব বেশি নাই। অধুনা নানাবিধ কারণে দীপ্তিরাশিতে কিঞ্চিৎ ছায়া ঘনাইতেছে বটে, তবু শাহরুখ-সম্ভাষণ হইতে কপিলমুনি-বন্দনা— কী দাপট! কিন্তু দাপট দেখাইলেই নেত্রী হওয়া যায় না। নেতা বা নেত্রীর কাজ কী, নেতৃ শব্দেই তাহার স্পষ্ট নির্দেশ আছে। শব্দটি ‘নী’ ধাতু হইতে নিষ্পন্ন। নী অর্থ নয়ন করা অর্থাৎ লইয়া যাওয়া। নেতৃ তিনিই, যিনি অন্যদের পথ দেখাইয়া লইয়া যান।
কাজটি বড় সহজ নহে। বহুজন যে পথে চলিতে চাহে, সচরাচর তাহা আলস্যের পথ, হঠকারিতার পথ, সস্তায় বাজিমাত করিবার পথ, আপন কর্তব্য পালন না করিয়া যাবতীয় অধিকার ভোগ করিবার পথ। যিনি যথার্থ নেতা, তাঁহার কাজ এই কুপথ হইতে মানুষকে নিরস্ত করা এবং তাহাদের পরিশ্রমের পথে, নীতির পথে, কর্তব্যপালনের পথে (আ)নয়ন করা। কাজটি কঠিন। প্রথমত, এ কাজ করিতে চাহিলে সর্বাগ্রে নিজেকে প্রস্তুত করিতে হয়। দ্বিতীয়ত, বহু মানুষকে এই পথে আনিবার জন্য ধৈর্য এবং শ্রমের প্রয়োজন হয়, অনেক সময়েই জনমনোরঞ্জনের বিপরীতে হাঁটিতে হয়, এমনকী বহু মানুষের— আপন অনুগামীদেরও— অসন্তোষ উৎপাদন করিতে হয়। নেতৃত্বের সরণি কুসুমাস্তীর্ণ নহে, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী বা নেলসন ম্যান্ডেলারা তাহা বিলক্ষণ জানিতেন। মানুষ কী চাহিতেছে, সেই অনুসারে আপন পথ স্থির করা নেতা বা নেত্রীর কাজ নহে, মানুষের কী চাওয়া উচিত, তাহা দেখাইয়া দেওয়াই তাঁহার কাজ।
নেতৃত্বের এই প্রাথমিক শর্ত পূরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যর্থ। তিনি জনসাধারণকে পথ দেখান না, জনসাধারণ যে পথে চলিতে চাহেন তিনি সেই পথে চলেন। তাঁহার জনপ্রিয়তা অবিরত জনমনোরঞ্জনের ফসল। সিঙ্গুরের আন্দোলন হইতে শুরু করিয়া টলিউড-বলিউড-টেলিউড ভজনা, বিষাক্ত চোলাই মদে মৃতদের জন্য ক্ষতিপূরণ হইতে ‘বাসভাড়া বাড়ানো চলিবে না’, সর্বক্ষেত্রেই তিনি জনতার মন ভুলাইয়া জনসমর্থন সংগ্রহ করেন। বস্তুত, তাঁহার নীতি কী, ‘এজেন্ডা’ কী, কখনওই জানা যায় নাই, কারণ তাঁহার ওই সব বস্তুর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, আমজনতা যাহা চাহে বলিয়া তিনি মনে করেন, উহাই তাঁহার নীতি, তাঁহার এজেন্ডা। জনপ্রিয়তার এই নিরন্তর সন্ধানেই মুখ্যমন্ত্রী ক্রমাগত রাজ্য সরকারের ছুটির তালিকা বাড়াইয়া চলিয়াছেন। ২০১১ হইতে ২০১৫, চার বছরে সরকারি ছুটির সংখ্যা বছরে ২৭ হইতে বাড়িয়া ৩২ হইতেছে, আগামী বছর দুর্গাপূজায় টানা এগারো দিন, কালীপূজা-দেওয়ালিতে টানা ছয় দিন সরকারি কাজ বন্ধ থাকিবে। ছুটিপ্রিয় বঙ্গবাসী তাঁহার উপর পরম প্রীত হইবেন। প্রীতি হইতে ভোট আসে, ভোট আসিলে রাজ্যপাট দীর্ঘায়িত হয়। আরও কিছু সময় হাতে পাইলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই ক্যালেন্ডারের বাকি তারিখগুলিকেও লাল কালিতে রাঙাইয়া দিতে সক্ষম হইবেন। নেতৃত্বের রক্তিমা সম্পূর্ণ হইবে।
আরও -
নৈতিকতার দায়
No comments:
Post a Comment