মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বড়সড় ধাক্কা দিয়ে সারদা কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বসু ওরফে টুম্পাইকে গ্রেফতার করল সিবিআই। সৃঞ্জয় একটি বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রের পাশাপাশি তৃণমূলের মুখপত্রেরও সম্পাদক। শুক্রবার টানা ছ’ঘণ্টা জেরার পরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
সৃঞ্জয়ের দু’টি ব্যক্তিগত এবং তাঁর সম্পাদিত বাংলা দৈনিকটির দু’টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও এ দিন সিল করে দেওয়া হয়েছে। দিনভর সিজিও কমপ্লেক্সের দফতরে জেরা করার পরে রাতে সৃঞ্জয়কে বিধাননগরের ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আজ, শনিবার তাঁকে আলিপুর আদালতে তোলা হবে বলে সিবিআই সূত্রে খবর।
সৃঞ্জয় দ্বিতীয় তৃণমূল সাংসদ, যিনি সারদা কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হলেন। এর আগে কুণাল ঘোষকে গ্রেফতার করে রাজ্যের গড়া বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। সিবিআই-ও তাঁকে হেফাজতে নিয়েছিল। একটি মামলায় তাঁকে চার্জশিটও দিয়েছে সিবিআই।
এ দিন গ্রেফতার হওয়া সৃঞ্জয়ের বিরুদ্ধে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করার অভিযোগ উঠেছে। গত বছর এপ্রিলে কলকাতা ছেড়ে উধাও হওয়ার আগে সুদীপ্ত সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে অভিযোগ করেছিলেন, সারদার হাতে থাকা বৈদ্যুতিন চ্যানেলকে সাহায্য করার ব্যাপারে সৃঞ্জয়ের সংবাদপত্রের সঙ্গে তাঁর চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৬০ লক্ষ টাকা করে মোট ২০ কোটি টাকা তিনি সৃঞ্জয়কে দিয়েছিলেন। সুদীপ্তর অভিযোগ ছিল, “আমাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, এই চুক্তির ফলে আমি নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালাতে পারব। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারব। সৃঞ্জয় এ-ও দাবি করেছিলেন যে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ।”
সিবিআইয়ের মুখপাত্র কাঞ্চন প্রসাদ এ দিন দিল্লিতে জানান, সারদা রিয়েলটি মামলায় সৃঞ্জয় বসুর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, টাকা নয়ছয় এবং বেআইনি ভাবে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরেই সৃঞ্জয়-সহ তৃণমূলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতার দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে। সেই তালিকায় ছিলেন কুণাল ঘোষ, মদন মিত্র, মুকুল রায় এমনকী মমতা নিজেও! যার জবাব দিতে গিয়ে ২০১৩ সালের ৩ মে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে দলীয় এক সভায় মমতা বলেছিলেন, “কুণাল চোর! মদন চোর! টুম্পাই (সৃঞ্জয়ের ডাকনাম) চোর! মুকুল চোর! আমি চোর!” এই তালিকার মধ্যে এই নিয়ে দু’জন গ্রেফতার হলেন। সিবিআইয়ের কাছ থেকে ডাক পেয়েছেন আরও এক জন মন্ত্রী মদন মিত্র।
এ দিনের ঘটনার পর বিরোধীরা মনে করছেন, সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই-কে যে দায়িত্ব দিয়েছিল, অর্থাৎ সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রভাবশালীদের চিহ্নিত করা, সেই কাজে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে তারা। ‘কান টানতে টানতেই মাথা আসবে’ মন্তব্য রাজ্যের এক বিরোধী নেতার।
মমতা গোড়ায় কুণালের পাশে দাঁড়ালেও পরে তাঁকে ত্যাগ করেন। নেত্রীর সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কুণালকেই সারদা-কাণ্ডে অন্যতম দোষী হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করেন তৃণমূল নেতারা। একই ভাবে তৃণমূলের সহ-সভাপতি তথা রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারকে সিবিআই গ্রেফতার করার পরে দল তাঁকে এক রকম অস্বীকার করে! সম্প্রতি নিজের বাড়িতে এক দলীয় কর্মিসভায় ফের মদন-মুকুলের পাশে দাঁড়ালেও সৃঞ্জয়ের নাম উচ্চারণ করেননি মমতা।
এ দিন সৃঞ্জয়ের গ্রেফতারের পরেও কোনও মন্তব্য করেননি তিনি। তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন অবশ্য বলেন, “আগের সরকার রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে সিবিআই-কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এখন বিজেপি তারই পুনরাবৃত্তি করছে!” তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সিবিআইকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দিল্লির এক পরামর্শদাতা সিবিআইয়েরও পরামর্শদাতা হয়েছেন। মানুষকে সঙ্গে নিয়েই তৃণমূল এর মোকাবিলা করবে।” নেতাজি ইন্ডোরে কলকাতা-সহ তিন জেলার দলীয় কর্মীদের নিয়ে আজ, শনিবারের সম্মেলন থেকে তৃণমূল নেত্রীই সারদা-মোকাবিলার বার্তা দেবেন বলে পার্থবাবু জানান। 
এ দিন কল্যাণীতে দলীয় সভায় তার মুখবন্ধও করেছেন মমতা। সেই সভা যখন হয়, তখনও সৃঞ্জয়ের গ্রেফতারির খবর আসেনি। মমতা বলেন, “সারদার কাছে মানুষ টাকা পাচ্ছে না, তার বিচার সিবিআই করুক।
কিন্তু ইদানীং দেখছি, সারদাকে কে প্রতারিত করেছে, তাদের নিয়ে মামলা চলছে। কে টিভি চ্যানেলে গিয়েছিল, কোন পুজোয় কী হয়েছিল, এটা তোমার এক্তিয়ার?”
স্বাভাবিক ভাবেই এর পাল্টা বলেছেন রাজ্যের বিরোধী নেতারা। পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, “সৃঞ্জয় বসু তৃণমূলের বড় নেতা এবং তিনি সারদা কেলেঙ্কারি সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। অন্যদের পাশাপাশি এ বারে তৃণমূলের দ্বিতীয় সাংসদ গ্রেফতার হলেন। মমতা বলেছিলেন, তিনি ইস্তফা দেবেন। এ বার তো অন্তত তাঁর পদত্যাগপত্র লেখার কাজটি শুরু করা উচিত!” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন ছিলেন দিল্লিতে। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী এ বারে কী বলবেন? তিনি যে পাঁচ জন ‘চোর’ কি না বলে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, তার মধ্যে দু’জন এখন জেলখানায়। আর এক জনও কার্যত জেলখানাতেই, কিন্তু বসে রয়েছেন হাসপাতালে! বাকি রইলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মুকুল রায়।”
সুর চড়িয়েছে সিপিএমও। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, “প্রথম ব্যক্তি এখন জেলে। দ্বিতীয় ব্যক্তিও গ্রেফতার হলেন। তৃতীয় ব্যক্তি সিবিআই গ্রেফতার এড়াতে বেলভিউ থেকে সরকারি হাসপাতালের প্রহরায়। বাকি দু’জনের অপেক্ষায় আছি!” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, “রাজনৈতিক সততা থাকলে সারদা তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ করা উচিত।” 
শুক্রবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে সিবিআই দফতরে ঢোকেন সৃঞ্জয়বাবু। এর আগেও তিন-তিন বার তাঁকে জেরা করেছেন তদন্তকারীরা। এ দিন ঢোকার সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হয়েছে। আমি দেশের নাগরিক হিসেবে এখানে এসেছি।” আপনি কি চিন্তিত? উত্তরে সাংসদ বলেন, “আমি তো কোনও ভুল করিনি। চিন্তা কেন হবে?” আপনার খবরের কাগজ এবং সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে জানতেই কি আপনাকে ডাকা হয়েছে? সৃঞ্জয়বাবু বলেন, “সবই তো সূত্র মারফত জানতে পারছেন বলে লিখে দিচ্ছেন। এটাও লিখে দিন।” রাতে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরনোর সময়ে অবশ্য আর কোনও মন্তব্য করেননি তিনি।
এ দিন সিবিআই দফতরে ডেকে পাঠানো হয়েছিল তৃণমূলের আরও এক প্রাক্তন সাংসদ সোমেন মিত্রকে। এখন তিনি কংগ্রেসে। সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, “আমি অবাক! ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্য হিসেবে আমি একবার সেবি-কে চিঠি লিখেছিলাম। সে বিষয়েই আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।” সিবিআই সূত্রে খবর, ইস্টবেঙ্গলের এক কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার সুদীপ্ত-র সঙ্গে সেবি অফিসারদের যোগাযোগ রক্ষা করতেন বলে তদন্তে সিবিআই জানতে পেরেছে। দেবব্রতকে গ্রেফতারও করেছে তারা। সেই ক্লাবেরই সদস্য হিসেবে সোমেনবাবু সেবি-কে কেন চিঠি দিয়েছিলেন, তা খতিয়ে দেখতে চান তদন্তকারীরা।
এ দিন সাড়ে দশটায় সিবিআই দফতরে ঢোকেন রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়। বেরিয়ে যান সাড়ে বারোটা নাগাদ। তিনি বলেন, “কিছু তথ্য দিতে এসেছিলাম। ল্যান্ডমার্ক সিমেন্ট কারখানা ও কিছু জমি সংক্রান্ত যা যা জানতে চাওয়া হয়েছে, তাও জানিয়েছি। আরও কিছু তথ্য সিবিআই আমার কাছ থেকে চেয়েছে। আমি তা পাঠিয়ে দেব।”

আরও - 
সারদা তদন্তে জালিয়াত তৃণমূলী 'চিত্রকর' শুভাপ্রসন্নর মিথ্যে তথ্য! 

রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে, মমতার মতো, রাজ্যের এত বড় ক্ষতি আর কেহ কখনও করেন নি