শিমুলিয়ার মাদ্রাসায় মাটির নীচে কিছু আছে জানিয়ে দিয়েছে বম্ব স্কোয়াড। একটি সুড়ঙ্গেরও আভাস মিলেছে। যদিও সেখানে কতটা বিপদ অপেক্ষা করছে, তা অজানা।
এই পরিস্থিতিতে এনআইএ-র তদন্তকারীদের সুরক্ষা দিতে আজ, বুধবার বর্ধমানের মঙ্গলকোটে ওই মাদ্রাসায় ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের (এনএসজি) আসার কথা। দু’দিন হল শিমুলিয়ায় তদন্তে নেমেছে এনআইএ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিআইডি-র বম্ব স্কোয়াডেরা লোকেরা চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে রিপোর্ট দেওয়ার পরেই তড়িঘড়ি এনএসজি নামানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ দিনই ডিআইজি (এনআইএ) অনুরাগ তনখা বর্ধমানে পৌঁছন। তাঁর সঙ্গে সিআরপি-র একটি দলও শিমুলিয়ায় যাচ্ছে।
জঙ্গি মোকাবিলায় বিশেষ ভাবে পারদর্শী এনএসজি-কে সাধারণত দু’টি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় এক) পণবন্দিদের মুক্ত করা বা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে শত্রুর ডেরায় হানা দেওয়া। যেমন দেখা গিয়েছিল মুম্বইয়ে ২৬/১১-র জঙ্গি আক্রমণের সময়ে। দুই) কিছু ক্ষেত্রে ভিভিআইপি-দের নিরাপত্তা দিতে। শিমুলিয়ায় এনএসজি-কে পাঠানোর দু’টি কারণই রয়েছে।
সিআইডি সূত্রের খবর, শিমুলিয়ার মাদ্রাসায় যে সুড়ঙ্গের আভাস মিলেছে, তার ভিতরে তল্লাশি চালাতে গেলে বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তা এনএসজি-রই আছে। সম্ভবত সেই কারণেই বম্ব স্কোয়াডের কাছ থেকে সুড়ঙ্গের কথা শোনা মাত্র এনএসজি কম্যান্ডোদের ডেকে পাঠানো হয়েছে। যদিও এনআইএ-র একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, তারা এনএসজি-কে ডাকেনি, আবার আসতে বারণও করেনি। কারণ পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে তদন্ত চালাতে গিয়ে অফিসারেরা আক্রান্ত হতে পারেন, সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে কেন্দ্রীয় সংস্থা নামার পরেই তদন্তের গতিপ্রকৃতি পাল্টে গিয়েছে। প্রথমটায় পুলিশ যে ঢিলেঢালা মানসিকতা দেখিয়েছে, তাতে কেন্দ্রীয় অফিসারেরা যথেষ্ট বিরক্ত। বিস্ফোরণের দিন তিনেকের মধ্যেই শিমুলিয়া মাদ্রাসার কথা জানতে পেরেছিল বর্ধমান পুলিশ। কিন্তু তারা দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনেক মালপত্র সমেত এখানকার লোকজন সরে পড়তে পেরেছে বলে সন্দেহ এনআইএ-র। সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক দল গিয়ে মাদ্রাসার সামনে পড়ে থাকা ন্যানো গাড়িটিও পরীক্ষা করে। ওই গাড়িতেই ইউসুফ ও তার সঙ্গী বোরহান শেখ ঘোরাফেরা করত বলে এলাকার লোকজন গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন। গাড়িটির ভিতরে রক্তের দাগ ও কিছু জামাকাপড় মিলেছে।
এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ ডিএসপি পদমর্যাদার এক আধিকারিকের নেতৃত্বে এনআইএ-র চার সদস্যের দল শিমুলিয়া পৌঁছয়। সঙ্গে ছিল পুলিশ। বাড়ির পিছনের দিকে মাটি থেকে ফুটখানেক উপরে ছোট-ছোট জানলা। ঘরে খাট নেই। মেঝেয় শুয়ে কথা বললে যাতে বাইরে দাঁড়িয়ে তা শোনা না যায়, সে জন্যই এত নিচু জানলা তৈরি করা হয়েছিল বলে গোয়েন্দাদের অনুমান। এখানে ২০-২৫ জন থাকত বলে জানান তাঁরা। বাড়িটির ভিতরে একটি কুয়োয় তল্লাশি চালিয়েও কিছু মেলেনি।
পালানোর আগে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা কিছু মালপত্র ফেলে দিয়ে থাকতে পারে সন্দেহে দুপুর ১২টা নাগাদ মাদ্রাসার পাশের পুকুরে লোক নামানো হয়। তাতে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। পাড়ে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছিলেন এনআইএ-র অফিসারেরা। তল্লাশি চালিয়েও ডোবা থেকে যখন কিছু মিলছে না, এক অফিসার আক্ষেপ করেন, “এখানে জেহাদের প্রশিক্ষণ চলছিল। তিন-চার দিন সময় পেয়েই পালিয়ে গিয়েছে।” কিন্তু অফিসারদের সন্দেহ যায়নি। পুকুরের মালিককে রাতের মধ্যে সব জল তুলে ফেলতে বলা হয়েছে।
দুপুর দেড়টা নাগাদ মাদ্রাসা থেকে সামান্য দূরে বোরহানের বাড়িতে যায় এনআইএ-র দল। প্রথমে ঢুকতে দিতে চাননি পরিবারের লোকজন। জোর করে দরজা খুলিয়ে ঢোকেন অফিসারেরা। ভিতরে গিয়ে বোরহানের মা, বৌদি ও দিদিমার সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। নানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়ে মা আসুরা বিবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তিনি বলেন, “আমি এক হতভাগী মা। ইউসুফকে মাদ্রাসার জমি দিয়ে আমার ছেলে বড় ভুল করেছে। ইউসুফ ও তার স্ত্রী আয়েষা মাদ্রাসাতেই থাকত। বোরহানের স্ত্রী সাহনওয়াজও ওখানেই থাকত। ঈদুজ্জোহার চার দিন আগে ওরা চলে গিয়েছে।” বোরহানের কাকা সফিকুল শেখকেও ডেকে পাঠিয়ে জমি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে এনআইএ।
দুপুর ২টো নাগাদ এনআইএ-র একটি দল খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণস্থলে যায়। সেখানে থাকা সমস্ত নমুনা পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ বাড়িটি ‘সিল’ করে বেরিয়ে যায় তারা। ওই সব নমুনা কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হবে বলে এনআইএ সূত্রে জানা গিয়েছে। বিকেলে মঙ্গলকোট থানায় বসে ঘণ্টা তিনেক ধরে শিমুলিয়া মাদ্রাসার পরিচালক ইউসুফ শেখের মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশনের গতিবিধি লক্ষ করেন এনআইএ অফিসারেরা।
এ দিন দুপুরেই মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থানায় আসেন এনআইএ-র তিন গোয়েন্দা। দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ তাঁরা বেলডাঙার পাওয়ার হাউস পাড়ার অলিওল ইসলামের বাড়ি যান। অলিওলের এই বাড়িই গত প্রায় তিন বছর ধরে ভাড়া নিয়েছিল খাগড়াগড় বিস্ফোরণে হত শাকিল আহমেদ। এ দিন এনআইএ যাওয়ার আগেই সিআইডি সেখানে গিয়ে অলিওলকে জেরা করে। পরে এনআইএ অফিসারেরা গিয়ে প্রচুর ছবি তোলেন। শাকিল যে ঘরে থাকত, সেখান থেকে তাঁরা দু’টি ব্যাগও উদ্ধার করেছেন। সেই ব্যাগে তুষ ও কিছু লিফলেট (আরবি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা) ছিল। লাগোয়া বাড়ির মালিক মুস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী আফিফা বিবি গোয়েন্দাদের জানান, শাকিলের বাড়ির বারান্দা ও ঘর বড় পর্দা দিয়ে সব সময়ে ঢাকা থাকত। কিছুই দেখা যেত না।
সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বীরভূমের নানুরে পৌঁছয় এনআইএ-র তিন সদস্যের একটি দল। পুলিশের সঙ্গে তাদের বৈঠক চলার সময়েই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ এসআইবি-র দুই অফিসার এসে পৌঁছন। রাত ৮টা নাগাদ এনআইএ-র দলটি বেরিয়ে বোলপুরের দিকে রওনা দেয়। পুলিশ সূত্রের খবর, গত শনিবার কদর গাজির বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া পোড়া কাগজপত্র, ডায়েরি-সহ বাজেয়াপ্ত করা জিনিসপত্র তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এসডিপিও (বোলপুর) সূর্যপ্রতাপ যাদবের কাছে তারা জেনারেটর, বাংলা জানা লোক আর পুলিশ বাহিনী চেয়েছে। রাতে উত্তরবঙ্গেও পৌঁছয় এনআইএ-র একটি দল। ধূপগুড়ি ও জয়গাঁয় তাদের যাওয়ার কথা বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
অন্য দিকে, নদিয়ার করিমপুর এলাকাতেও এক গ্রামীণ চিকিৎসকের খোঁজ শুরু করেছে সিআইডি। থানারপাড়াতেও তার খোঁজে হানা দেওয়া হয়। সিআইডি-র দাবি, ওই গ্রামীণ চিকিৎসকের সন্ধান পেলেই খাগড়াগড় বিস্ফোরণ সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসবে। এনআইএ-র তদন্তকারীদের কাছে ওই গ্রামীণ চিকিৎসকের নাম উঠে এসেছিল। তারাই সিআইডি-কে ওই চিকিৎসকের খোঁজ করতে বলেছে।


****************

ইংরেজবাজার

ধামাচাপা আর এক বিস্ফোরণ ফাঁস করল এনআইএ

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় ও পীযূষ সাহা (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)

কলকাতা ও মালদহ, ১৫ অক্টোবর, ২০১৪

মালদহের বৈষ্ণবনগরের বিস্ফোরণ নিয়ে দায়সারা পুলিশি তদন্তের অভিযোগ ইতিমধ্যে উঠেছে। এ বার জানা গেল, বৈষ্ণবনগরের আগে ইংরেজবাজারে সকেট বোমা বিস্ফোরণের একটি ঘটনাও পুরোপুরি চেপে গিয়েছে মালদহ জেলা পুলিশ!
তা প্রকাশ হল বর্ধমান-কাণ্ডে এনআইএ-র তদন্তের সূত্রেই। স্থানীয় সূত্রের দাবি, গত ৫ অক্টোবর ইংরেজবাজারে ওই বিস্ফোরণে তিন জন মারা যায়, গুরুতর আহত হয় তিন জন। মৃতদেহগুলো যেমন তড়িঘড়ি সরিয়ে ফেলা হয়, তেমন আহতদের কার্যত চুপিসাড়ে এনে ভর্তি করানো হয় কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। যদিও নিজেদের সূত্র মারফত খবর পেয়ে পার্ক সার্কাসের সেই হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছে এনআইএ। তারা এখন জানার চেষ্টা করছে, খাগড়াগড়-কাণ্ডের সঙ্গে ইংরেজবাজারের কোনও যোগসূত্র আছে কি না। জেলা পুলিশ অবশ্য ইংরেজবাজারে বিস্ফোরণে প্রাণহানির কথা মানতে রাজি নয়। আবার হাসপাতালের দাবি, তিন জনকে পুলিশ প্রহরায় আনা হয়েছিল। অন্য দিকে পুলিশের দাবি, তারা হাসপাতাল থেকেই ওদের ভর্তি হওয়ার কথা জানতে পেরেছে।
আর এ সব চাপান-উতোরের মাঝেই ফাঁস হয়ে গিয়েছে যে, ইংরেজবাজারে বিস্ফোরণ একটা ঘটেছিল। কিন্তু এনআইএ কী ভাবে আহতদের খোঁজ পেল?
তদন্তকারী-সূত্রের খবর: এনআইএ-র কাছে খবর এসেছিল, বর্ধমান বিস্ফোরণে গুরুতর আহত তিন ব্যক্তি পার্ক সার্কাসের হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছে। সেই মতো সোমবার রাতে এনআইএ-র লোকজন ওখানে পৌঁছে যান। দু’জনের ছবি তোলার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন তদন্তকারীরা, চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্রের ছবিও তুলে নিয়ে যান। আর এক আহত আইসিসিইউয়ে থাকায় তার সঙ্গে অবশ্য এনআইএ কথা বলতে পারেনি। তবে আহতদের নিরাপত্তায় রাজ্য পুলিশ ও কড়েয়া থানার পুলিশের ‘ঢিলেমি’ কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের নজর এড়ায়নি।
মঙ্গলবার পার্ক সার্কাসের হাসপাতালটিতে গিয়ে জানা গেল, আহত তিন জন ইংরেজবাজার থানা-এলাকার বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা গ্রাম নরেন্দ্রপুরের বাসিন্দা। নাম উজের শেখ, আবদুল্লাহ শেখ ও জসিম শেখ। পাঁচ তারিখ বিকেল চারটে নাগাদ গ্রামের এক আমবাগানে সকেট বোমায় ওঁরা আহত হন। তাতে তিন জন নিহত হন বলে স্থানীয় সূত্র দাবি করলেও পুলিশ মানতে নারাজ। পুলিশের বক্তব্য, ঘটনাস্থলে দেহ মেলেনি। তবে আমবাগান জুড়ে পোড়া গন্ধ ছিল, আহতেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিলেন।
প্রসঙ্গত, গত ১২ অক্টোবর বৈষ্ণবনগরের বাজারতি গ্রামে এক সক্রিয় তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। এবং তাতেও পুলিশ দায়সারা তদন্ত করেছে বলে অভিযোগ। ইংরেজবাজার-কাণ্ড ফাঁস হওয়ার পরে বিরোধীদের প্রশ্ন, পুলিশ কি দুই ঘটনায় অভিযুক্তদের আড়াল করতে চাইছে? মালদহ জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারির মন্তব্য, “মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীই ইংরেজবাজারের কাণ্ড ধামাচাপা দিতে চাইছেন। পুুলিশ কোন সাহসে তদন্ত করবে?” সিপিএমের জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্রের আক্ষেপ, “দলের একাংশ জড়িয়ে পড়েছে দেখে মন্ত্রী নীরব ভূমিকা পালন করছেন।” বিজেপি’র জেলা সাধারণ সম্পাদক অজয় গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, “তৃণমূল কর্মীরা জড়িয়ে পড়ছে বলেই মন্ত্রী পরিকল্পিত ভাবে নীরব।”
স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুবাবু অবশ্য অভিযোগ মানতে নারাজ। “পুলিশ পুলিশের কাজ করছে। আমি এসপি’কে বলেছি আইনের শাসন বলবৎ করতে হবে।” জানিয়েছেন তিনি। পুলিশের ভূমিকা কি প্রশ্নাতীত?
মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার দাবি করেছেন, কাউকে আড়াল করতে কিংবা তথ্য-প্রমাণ লোপাট করতে পুলিশ কাউকে সাহায্য করছে না। “জখম তিন জনের চিকিৎসা চলছে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে উঠলেই তাদের গ্রেফতার করে আদালতে তোলা হবে।” বলেছেন এসপি। বৈষ্ণবনগর প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “ওখানে এক জনকে ধরা হয়েছে। মূল অভিযুক্ত কামাল শেখ ও তার ভাইদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।”
ইংরেজবাজারে ঠিক কী হয়েছিল?
পুলিশের দাবি: দুষ্কৃতীরা মাচায় বসে বোমা বাঁধছিল, তখন বিস্ফোরণ হয়। অন্য দিকে আহতেরা এ দিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে দাবি করেছেন, ওঁরা আমবাগানে যখন তাস খেলছিলেন, তখন মুখে গামছা বাঁধা তিন জন মোটরবাইকে চেপে এসে বোমা ছুড়ে চম্পট দেয়। এনআইএ-কেও তাঁরা একই কথা বলেছেন। উজের শেখের চোখে স্প্লিন্টার ঢুকে গিয়েছে। বুক-হাত-পা ক্ষতবিক্ষত। জানালেন, “আমি লরি ড্রাইভার। সরকারি মাল নিয়ে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করি। শেষ বার ঈদের সময়ে গিয়েছিলাম। বোমা বাঁধতে যাব কেন?” কিন্তু খামোখা তাঁদের কেউ বোমাই বা মারবে কেন? উজেরের জবাব, “তা জানি না। আমার কোনও শত্রু নেই। সৎ ভাবে রোজগার করি।”
আবদুল্লাও গাড়িচালক। তাঁরও চোখ মারাত্মক জখম। এ দিন চোখে অস্ত্রোপচার হওয়ায় তিনি কথা বলতে পারেননি। অবস্থা সবচেয়ে খারাপ জসিম শেখের। সারা শরীরে অসংখ্য আঘাত। জ্ঞান নেই, আপাতত ভেন্টিলেশনে। পুলিশ-সূত্রের খবর, প্রথমে তিন জনকেই মালদহ শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ৭ তারিখে উজের ও জসিমকে কলকাতায় আনা হয়। ১০ তারিখে আনা হয় জসিমকে। মালদহ পুলিশের দাবি, তারা হাসপাতাল থেকেই তিন জনের ভর্তি হওয়ার খবর জানতে পেরেছে।
কিন্তু পুলিশের চোখ এড়িয়ে এমন মারাত্মক আহত তিন জন কলকাতায় পৌঁছল কী ভাবে?
এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা মেলেনি।

**************

এ বার লালগোলা

পোড়া কাগজ পড়ে, উধাও প্রতিষ্ঠাতা

অনল আবেদিন ও বিমান হাজরা (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)

লালগোলা, ১৫ অক্টোবর, ২০১৪, 

নোটিসটা ঈদের ছুটির। ছুটি ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত। তার পর দিন হাজির না হলে ৫০ টাকা জরিমানা। তার পরেও গরহাজির থাকলে প্রতিদিন জরিমানা ১০ টাকা করে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের লালগোলার মকিমনগরের এক অননুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই নোটিস যিনি দিয়েছেন, সেই মোফাজ্জুল শেখ কবে আবার সেখানে হাজির হবেন বা আদৌ হাজির হবেন কি না তা নিয়েই ধন্দ দেখা দিয়েছে। কারণ, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে অভিযুক্ত আব্দুল হাকিম, রাজিয়াবিবি, আলিমাবিবির সূত্রে মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসা ছাড়াও জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) রেডারে রয়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিস্ফোরণ-কাণ্ডের পরে সপরিবার এলাকাছাড়া ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা মোফাজ্জুল।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০০৮ সালে মকিমনগরে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন স্থানীয় বাসিন্দা পাট-আলু-ডিমের ব্যবসায়ী তথা রাজমিস্ত্রির ঠিকাদার মোফাজ্জুল। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ হয় ২ অক্টোবর। ৭ অক্টোবর থেকে তিনি সপরিবার নিখোঁজ। তবে বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ধৃত রাজিয়া, আলিমা ও হাকিমের ছবি সংবাদমাধ্যমে দেখে চমকে উঠেছিলেন এলাকাবাসী। সাত-আট মাস আগেও হাকিমকে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রান্না করতে দেখেছেন তাঁরা। সেই সুবাদেই সেখানে যাতায়াত ছিল রাজিয়া-আলিমার।
মঙ্গলবার ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেল, ভবনটির দু’টি অংশ। একটিতে ঢালাই ছাদ রয়েছে। আর একটি ইটের গাঁথনি দেওয়া, ছাদ টিনের। অফিসঘর তালাবন্ধ। বাইরের দিকে শুধু একটি জানলা খোলা। দু’টি স্নানাগার ও সাতটি শৌচাগার রয়েছে। শৌচাগারের একটিতে পড়ে রয়েছে কিছু পোড়া কাগজ। এতটাই পুড়েছে যে, তা থেকে কিছু উদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব। ১৪টি ঘরের একটিতে পড়ে আছে বেশ কয়েকটি ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। আর একটিতে দেখা গিয়েছে একটি সিম-কার্ড। ভাঙা। রান্নাঘরের পাশের ঘরে একটি সাইকেল ও দু’টি মোটরবাইক, একটি মোটরবাইকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর অন্য জেলার। প্রতিটি ঘরেই রাখা রয়েছে ট্রাঙ্ক। এবং সেগুলোর বেশিরভাগই তালাবন্ধ। কিছু খোলা ট্রাঙ্কে রয়েছে বই ও জামাকাপড়। রান্নাঘরে দু’টি বড় কাঠের উনুন, একটি গ্যাস সিলিন্ডার। আর আছে চাল, নুন ও লঙ্কাগুঁড়ো।
এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৌচাগারে যে পোড়া কাগজ মিলেছে, তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আমাদের অনুমান, আপত্তিকর কোনও নথি পোড়ানো হয়েছে।” মোফাজ্জুলের খোঁজ চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এলাকাটি বাংলাদেশের গোদাগাড়ি উপজেলা থেকে বড়জোর ৯ কিলোমিটার দূরে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই। স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রথম দিকে নদিয়ার দেবগ্রামে নিজের শ্বশুরবাড়িতে থেকে লোহার ব্যবসা করতেন মোফাজ্জুল। বছর দশেক আগে গ্রামে ফিরে তিনি ঠিকাদারির পাশাপাশি ডিম, আলু ও পাটের কারবার শুরু করেন। ২০০৮ সালে মকিমনগরে নিজের বাড়িতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। ২০১১ নাগাদ তিনশো মিটার দূরে মাঠের মধ্যে ১২ কাঠা জমি কিনে বাড়ি তৈরি করে সেখানে পড়ানোর বন্দোবস্ত করেন তিনি। শুরু থেকেই এখানে শুধু ছাত্রীরা পড়ত। প্রথম দিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে দু’-এক জন পুরুষ শিক্ষক থাকলেও পরবর্তী কালে শিক্ষিকারাই পড়াতেন। ১৩০ জন ছাত্রী বর্তমানে সেখানে পড়াশোনা করে। অর্ধেকের বেশি পড়ুয়া আবাসিক। জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা ছাত্রীরাও রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি মাসে দেড়শো টাকা। আবাসিকদের প্রতি মাসে আরও ৪০০ টাকা করে বেশি দিতে হয়। প্রতিটি ক্লাসঘরে পাখা, আলো ও ঘড়ির ব্যবস্থা থাকলেও বসার কোনও বেঞ্চ বা চেয়ার নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ছাদে চার দিকে প্রাচীর অন্তত পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, ছাদে কী হচ্ছে।
এনআইএ সূত্রের দাবি, হাকিম-রাজিয়াদের জেরা করে তারা জেনেছে, শিমুলিয়ার মতো পড়ুয়াদের জেহাদি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করা বা জঙ্গি-প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো এখানে। এমনকী, ভিন্ দেশ থেকে আসা লোকও  ‘মগজ ধোলাই’-এর কাজে আসত বলে সন্দেহ করছেন গোয়েন্দারা।
বিস্ফোরণের তদন্তে নাম উঠে আসায় গত ৯ অক্টোবর ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যান পুলিশ ও গোয়েন্দারা। কিন্তু মোফাজ্জুলকে পাননি। স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশকে জানিয়েছেন, পরিবারটি কোথায় তাঁরা জানেন না। পুলিশ সূত্রের দাবি, মোফাজ্জুলের গোটা তিনেক মোবাইল নম্বর রয়েছে। তার একটিতে ফোন করে তাঁকে ওই প্রতিষ্ঠানে ডাকে পুলিশ। তিনি সেখানে আসার প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু আসেননি। তার পর থেকে তাঁর ওই নম্বরের মোবাইলটি বন্ধ। অন্য যে দু’টি নম্বর রয়েছে, সেগুলিতে ডায়াল করলে কেউ ফোন ধরছে না।
মোফাজ্জুলের সঙ্গে তাঁদের বিশেষ বনিবনা হত না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে। এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেছেন, “এই প্রতিষ্ঠানে মাঝেমধ্যে কিছু পুরুষ আসতেন, তাঁদের বিবিরা সেখানে লেখাপড়া করেন, এই পরিচয় দিয়ে।” তাঁদের একটা বড় অংশের সংযোজন, “টিভিতে হাকিম, আলিমা ও রাজিয়াকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। ওদের সবাইকেই তো চিনি। ভেবেছিলাম, মোফাজ্জুলের কাছে কী হয়েছে জানতে চাইব। কিন্তু ও তো সপরিবার নিখোঁজ!”

আরও পড়ুন - কাদের স্বার্থে বর্ধমান এস পি বিস্ফোরণের প্রমাণ নষ্ট করল এবং ভুল রিপোর্ট দিয়ে তদন্ত ভুলপথে চালিত করতে চাইলেন কাকে বাঁচাতে?