কওসরকে ঘরভাড়া পেতে সাহায্য করার আক্ষেপ যায়নি কাশেমের
সুনন্দ ঘোষ (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
বর্ধমান, ১৫ অক্টোবর, ২০১৪,
খাগড়াগড়ের বাড়িতে তদন্তকারীরা। মঙ্গলবার। ছবি: উদিত সিংহ।
বাড়ি ভাড়া পাওয়ার জন্য সাহায্য চেয়েছিল এক জন। ইমাম হিসেবে বিভিন্ন লোকের আবেদনে সাড়া দেওয়াটাই অভ্যাস। এই আবেদনও সে ভাবেই দেখেছিলেন কাশেম মোল্লা। কিন্তু মাস তিনেক আগে ওই ব্যক্তিকে সাহায্য করার জন্য এখন আক্ষেপের শেষ নেই বর্ধমান সদরের এক মসজিদের এই ইমামের।
গোয়েন্দারা ইতিমধ্যেই জেনেছেন, বর্ধমানের বাবুরবাগে যে বাড়ির দোতলায় ডেরা বেঁধেছিল খাগড়াগড়-বিস্ফোরণের অন্যতম পাণ্ডা কওসর, সেটি ভাড়া পাওয়ার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিলেন কাশেম। এই ইমাম থাকেন বাহির সর্বমঙ্গলা এলাকায়। পরিচয়ের সুবাদে বাবুরবাগে আব্দুর রেজ্জাকের বাড়ির দোতলা ফাঁকা আছে বলে জানা ছিল কাশেমের। তাঁর দাবি, নমাজ পড়তে এসে তার সঙ্গে দেখা করে কওসর জানিয়েছিল, তার ও ভায়রাভাইয়ের পরিবারের থাকার জন্য বাড়িভাড়া দরকার। তাই তিনি রেজ্জাকের কাছে পাঠান কওসরকে।
বাড়িতে গিয়ে মঙ্গলবার কাশেমের দেখা মেলেনি। তবে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “কওসর কেমন দেখতে, তা ভুলে গিয়েছি। আমরা অনেককেই নানা ভাবে সাহায্য করে থাকি। এ ক্ষেত্রেও সে রকমই করেছিলাম। কিন্তু, এখন আমি লজ্জিত ও দুঃখিত, যে আমার মাধ্যমে এ রকম একটি লোক ঘরভাড়া পেয়েছিল। ওদের উপযুক্ত সাজা হোক, এটাই চাইছি।”
কাশেমের সঙ্গে কথা বলেছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের ঘারণা, বাবুরবাগ বা খাগড়াগড়ের আগেও কওসর ও তার সঙ্গীরা বর্ধমান শহরের অন্দরে ঘাঁটি গেড়েছিল। বার বার এলাকা ঘুরে তারা বেশ কিছু জায়গা চিহ্নিত করেছিল, যেখানে নিরাপদে ঘাঁটি গাড়তে পারবে তাদের মনে হয়েছিল।
খাগড়াগড় ও বাবুরবাগদু’টি এলাকা জুড়েই মেস-বাড়ির ছড়াছড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়-সহ নানা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা থেকে শুরু করে, কাজের সূত্রে আসা বহু মানুষজন থাকেন সেই সব বাড়িতে। তাই এ সব এলাকায় অপরিচিত কাউকে দেখলে এলাকাবাসী চট করে সন্দেহ করেন না। এই কারণেই ডেরা বাঁধার জন্য এই এলাকাকে কওসরেরা বেছেছিল বলে ধারণা গোয়েন্দাদের।
বাবুরবাগের বাড়িটি মাস তিনেক আগে ভাড়া নিয়েছিল কওসর। তার সঙ্গে এসে উঠেছিল হবিবুর। থাকত দুই মহিলাও, যাদের বোরখা ছাড়া কখনও দেখেননি এলাকাবাসী। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অনেক ভাড়াটেই স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা করেন। কিন্তু ওই বাড়ির দোতলার ভাড়াটেরা তেমন ছিল না। বাড়ির কাছেই রয়েছে একটি ক্লাব। তার সদস্য শেখ নাসিম, আব্দুল রহমানেরা বলেন, “বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা আফগানিস্তানের তিন ছাত্র গত বছর বাড়িটির নীচের তলায় থাকতেন। তাঁরা তো আমাদের ক্লাবের টিভি-তে খেলা দেখতে আসতেন। ভলিবল, ক্রিকেটও খেলতেন আমাদের সঙ্গে।”
ওই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই একটি চালাঘরে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন আব্দুর রেজ্জাকের ভাগ্নে ওমর হোসেন। তাঁরা জানান, কওসর সব সময়েই হেলমেট পরে থাকত। দোতলা থেকে হেলমেট পরে নেমে মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে যেত। আবার ফিরে এসে মোটরবাইক রেখে হেলমেট পরেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেত।
ওমর পেশায় ধোপা। তিনি বলেন, “জামকাপড় শুকোতে দেওয়ার জন্য আমাকে ওই বাড়ির ছাদ ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু ওরা আসার পরে আমাকে ছাদে উঠতে দিতে বাধা দেয়। জোরাজোরি করায় ছাদে যেতে দিত। তবে গলা খাঁকারি দিয়ে উপরে উঠতে বলেছিল।” তাঁর স্ত্রী সালমা বলেন, “এরা আমাদের সঙ্গে কখনও কথা বলত না। যে দুই মহিলা ছিল, তাদের তো বোরখা ছাড়া দেখিইনি।”
কওসরের সঙ্গী বোরখা পরা দু’জন মহিলা কি না, তা নিয়ে আবার সংশয় রয়েছে বাড়িটির নীচের তলায় থাকা ছাত্রদের। চাকরির নানা পরীক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে বর্ধমানে আসা এই ছাত্রেরা মেস করে ওই বাড়িটিতে রয়েছেন বছরখানেক। ২ অক্টোবর বিস্ফোরণের পরে, বাবুরবাগের বাড়ির দোতলায় আলো জ্বলতে দেখে মালিককে খবর দেন তাঁরাই।
পর দিন সকালে মালিক এসে দেখেন, দু’টি ঘর বন্ধ করে ভাড়াটেরা পালিয়েছে। বাড়িটির সন্ধান মেলার পরে দোতলার পাশাপাশি নীচের তলাও তালাবন্ধ করে দিয়ে দিয়েছে পুলিশ। তাই সেখানে ফিরতে পারছেন না ওই ছাত্রেরা। তাঁদেরই এক জন, মঙ্গলকোটের হাফিজুর রহমান ফোনে বলেন, “হেলমেট পরা লোকটিকে নামতে-উঠতে দেখে কয়েক বার ‘সালাম আলেকুম’ বলেছি। প্রত্যুত্তর দেয়নি। বাকি দু’জন মহিলা না পুরুষ, তা বুঝতেই পারিনি। কারণ, তারা পুরোপুরি বোরখায় ঢাকা থাকত। কখনও সাড়া বা গলার আওয়াজ পাইনি।” আর এক ছাত্র, গলসির সৈয়দ আবু শাহিদ বলেন, “যে লোকটা হেলমেট পরত না, সে দাড়িওয়ালা। পাশ দিয়ে যাতায়াত করলেও কখনও কথা বলেনি।”
পুজো ও ঈদের ছুটি শেষে ৯ অক্টোবর ফেরার কথা ছিল ওই ছাত্রদের। কিন্তু পুলিশ ঘরে তালা দিয়ে যাওয়ায় তাঁরা ফিরতে পারেননি। তাঁরা জানান, ভিতরে বইপত্র রয়ে গিয়েছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পরীক্ষা রয়েছে। কী ভাবে সেই পরীক্ষা দেবেন, তা নিয়েই এখন চরম দুশ্চিন্তায় কওসরের ডেরার নীচের তলার ওই ছাত্রেরা।
***************
ফিরলে পুলিশে দেব, বললেন হবিবুরের মা
মহেন্দ্র জেনা (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
বোলপুর, ১৫ অক্টোবর, ২০১৪,
হবিবুর এবং তাঁর মা জ্যোৎস্না বিবি। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
ছবি দেখেই বৃদ্ধা বলে উঠলেন, “এই তো আমার ছেলে!” খানিক পরে তাঁর স্বগতোক্তি, “যদি ও ফেরে, পুলিশে ধরিয়ে দেব।”
বৃদ্ধা হলেন হবিবুর শেখের মা। আর হবিবুর? খাগড়াগড়-কাণ্ডের সৌজন্যে নামটা আর অপরিচিত নয়। গোয়েন্দারাই জানিয়েছেন, ওই বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ কওসরের সঙ্গী এই হবিবুর। বর্ধমান শহরের বাবুরবাগের যে বাড়িতে কওসরের মূল ডেরা ছিল বলে তদন্তে উঠে আসছে, বীরভূমের হবিবুরের মাধ্যমেই সেই বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন। ওই বাড়িটির মালিকের বর্ণনা শুনে হবিবুরের স্কেচও আকানো হয়েছে।
সেই হবিবুরের মা জ্যোৎস্না বিবি মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমে নিজের ছেলের ছবি দেখেই চমকে উঠলেন। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঘটনা তিনি প্রতিবেশীদের মুখে শুনেছেন। তাঁদের বাড়িতে গিয়ে টিভিতে দেখেছেনও। পড়শিদের মুখে শুনেছেন ওই বিস্ফোরণ-কাণ্ডে নাম জড়িয়েছে ছেলের। বোলপুরের মুলুক এলাকায় শান্তিপল্লির বাড়িতে বসে বছর পঞ্চাশেকের ওই মহিলা বললেন, “শুনেছি, আমার ছেলে ওই ঘটনায় জড়িত। তা সত্যি হলে ও ফিরলে আমিই ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেব!”
গলা কিন্তু এতটুকুও কাঁপেনি!
তাঁর সঙ্গে হবিবুরের শেষ দেখা বছর দুয়েক আগে। সেই দিনের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “বছর দুয়েক আগে আমার অপারেশন হয়। অপারেশনের দিন ও আমায় দেখতে এসেছিল। পর দিন রাতেই নিজের জামাকাপড় নিয়ে ঘর ছাড়ল। কাউকে কিচ্ছু বলে গেল না!” বোলপুরের আরতি সিনেমার কাছে আগে একটি পানগুমটি ছিল হবিবুরের বাবার। হাবিবুর বাবার সঙ্গে দোকানে বসত মাঝে মাঝে। বাবা মারা গেলে সেই গুমটিতেই হবিবুর বসত। এ দিন হবিপুরের বিবাহিতা দুই দিদি টুম্পা ও ছবি বলেন, “মাঝরাতে নিজের পোশাক নিয়ে পালালেও দোকানের চাবি রেখে গিয়েছিল ভাই।” সেই দোকানটি এখন বিক্রি করে দিয়েছে ওই পরিবার।
গোয়েন্দারা জেনেছেন, হবিবুর মাস দুয়েক আগে বাবুরবাগে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেছিল। সেখানেই তার সঙ্গে কওসর ও তার স্ত্রী জিন্নাতুর ওরফে লক্ষ্মী থাকত। লক্ষ্মীর দাদা কদর গাজীর বাড়ি কীর্ণাহারের নিমড়া গ্রামে। হবিবুরের এক দিদি এ দিন বললেন, “কদরের এক বোনের সঙ্গে হবিবুরের বিয়ে হয়েছে বলে আমরা শুনেছি। কিন্তু, ওর বউকে কখনও চোখে দেখিনি।” বর্ধমান বিস্ফোরণের পর থেকেই স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে কদর। হদিস নেই হবিবুরেরও।
কেন পালাল হবিবুর , সে প্রশ্নের উত্তর নেই তার পরিবারের কাছে। তবে, এ দিন তার মা-দিদিদের মুখে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে শান্তিপল্লিরই বাসিন্দা ডালিম শেখের কথা। জ্যোৎস্না বিবির দাবি, “পালিয়ে যাওয়ার কিছু দিন আগে থেকেই ডালিমের সঙ্গে মাখামাখি শুরু হবিবুরের। তার পর থেকেই ধর্ম নিয়ে মাতামাতি শুরু করেছিল ছেলে।”
বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরে বিভিন্ন জেলায় দুষ্কৃতীদের নানা যোগসূত্র বের করছে গোয়েন্দারা।
মঙ্গলবার সিউড়িতে বীরভূম জেলা পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে
বেরিয়ে আসছেন এনআইএ-এর সদস্যরা।—নিজস্ব চিত্র।
ডালিমের আচরণ যে ‘রহস্যজনক’, সে কথা জানাচ্ছেন প্রতিবেশীরাও। পেশায় বাসনের ফেরিওয়ালা হলেও তাঁরা ডালিমকে একাধিক ল্যাপটপ ব্যবহার করতে দেখেছেন। এ দিন ডালিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, দরজায় তালা ঝুলছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, বছর ছয়েক আগে শান্তিপল্লিতে এসে সপরিবার থাকতে শুরু করেন ডালিম। বলেছিলেন, নলহাটির লোহাপুরে তাঁর আদি বাড়ি। ঈদের পর থেকেই ডালিমের দেখা মিলছে না বলে পড়শিরা জানান। জানা গিয়েছে, বহিরাগত তিন ব্যক্তিকে বছরখানেক আগে এই এলাকায় একটি খাস জমি কেনার বন্দোবস্ত করে দেয় ডালিম। সেই জমিতে ওই তিন জন নিজেরাই বাড়ি তৈরি করে। বাইরের কোনও মজুর-মিস্ত্রি নেয়নি তারা। পরিচয় দেয় বাসনের ফেরিওয়ালা হিসেবেই। আশপাশের লোকজন জানাচ্ছেন, পরিবার নিয়ে এলেও এলাকায় তারা মিশত কম। বাড়ির মেয়েদের বোরখা ছাড়া কার্যত দেখাই যেত না।
সেখানে গিয়ে দেখা গেল, উঁচু টিনের বেড়া দেওয়া তিনটি বাড়িতেই তালা বন্ধ। এক জনের বাড়ির উঠোনে পড়ে কার্তুজ। স্থানীয় সিয়ান-মুলুক পঞ্চায়েতের সদস্য প্রশান্ত মুখোপাধ্যায় বলেন, “কয়েক মাস আগে পঞ্চায়েত অফিসে এসেছিল ওই তিন জন। বাড়িতে চার চাকা যাওয়ার রাস্তার জন্য দাবি নিয়ে। আমরা বৈধ কাগজপত্র চাইলে ওরা আর ফিরে আসেনি।”
স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, ওই তিন জনেরই এক জনের বাড়িতে এ বছর দোলে হবিবুর এসেছিল। নিজের বাড়ি যায়নি। পরিবারের দাবি, সেখানেই হবিবুরের বিয়ে হয়। কিন্তু সে বাড়ির কাউকে ডাকেনি। হবিবুরের দিদি টুম্পা বলেন, “গ্রামে এসে বিয়ে করল, অথচ ডাকল না আমাদের! যে ভাইকে চিনতাম, সে অন্য হাবিবুর। ছেলেটা এতো বদলাল কী করে, বুঝতে পারছি না।”
****************
বছরখানেক ধরে অন্যত্রও বিস্ফোরক বানিয়েছে শাকিলরা
সুরবেক বিশ্বাস (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
কলকাতা, ১৫ অক্টোবর, ২০১৪
খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরে বর্ধমানে যে জঙ্গি মডিউল বা গোষ্ঠীটির হদিস মিলেছে, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বসে তারা অন্তত বছর খানেক ধরে আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বানিয়ে গিয়েছে এমনটাই মনে করছে এনআইএ।
জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার বক্তব্য, বর্ধমানের উপকণ্ঠে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের গবেষণাগার তথা কারখানাটির হদিস ২ অক্টোবর মিলেছে ঠিকই, তবে রাজ্যের অন্য জায়গায় অন্তত এক বছর ধরে ওই একই চক্র আইইডি তৈরি করেছে। এর বেশির ভাগটাই বাংলাদেশে পাচার করা হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে তদন্তকারীরা। শুধু তা-ই নয়, তদন্তকারীরা জেনেছেন, জেহাদি ভাবধারায় এ দেশের এক দল পুরুষ ও মহিলাকে উদ্বুদ্ধ করে বাংলাদেশে নাশকতা ঘটানোর জন্য তাদের দিয়ে মারণাস্ত্র তৈরি করাতে মাসের পর মাস ‘ক্লাস’ নিত ভিনদেশ থেকে আসা কয়েক জন লোক। বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ধরা পড়া রাজিয়া বিবি ওরফে রুমি কিংবা আলিমা বিবিদের এমন ভাবে মগজধোলাই করা হয়েছিল যে, ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তারা অনায়াসেই অন্য দেশে নাশকতা ঘটানোর চক্রান্তে যুক্ত হতে পেরেছিল। গাজা ভূখণ্ডের সাম্প্রতিক সংঘর্ষে প্যালেস্তাইনি শিশুদের উপর ইজরায়েলি হামলার বাছাই করা ভিডিও পর্যন্ত মহিলাদের দেখিয়ে তাদের ‘উদ্বুদ্ধ’ করা হয়েছিল। গোয়েন্দাদের দাবি, ধৃত রাজিয়া ও আলিমা এবং বিস্ফোরণে জখম আব্দুল হাকিমকে জেরা করে এমনই ইঙ্গিত মিলেছে। তা ছাড়া, বর্ধমানের শিমুলিয়া মাদ্রাসা-সহ কয়েকটি সন্দেহজনক জায়গা থেকে মেলা নথিপত্রও একই দিকে ইশারা করছে।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, ধৃতদের মুখ থেকে এখনও এই ব্যাপারে সরাসরি কথা বার না-করা গেলেও তাদের জেরা করে বোঝা যাচ্ছে, ২০১২-তে ওই চক্রের সদস্যদের আইইডি তৈরির প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রাথমিক পাঠ শেষ হয়। পরের বছরই তারা পুরোদস্তুর ‘কাজে’ নেমে পড়ে। এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, “যা মনে হচ্ছে, খাগড়াগড়ে ওই কারখানা বা গবেষণাগার তৈরি হওয়ার বছর খানেক আগেই আইইডি উৎপাদনের ওই রকম অন্তত একটি জায়গা তৈরি করা হয়। আর সেখানে বানানো শ’য়ে শ’য়ে আইইডি এবং অন্যান্য মারণাস্ত্র পাচার করা হয়েছে বাংলাদেশে।” এনআইএ-র এক অফিসারের মতে, “প্রচুর সংখ্যায় আইইডি তৈরির বরাত তাদেরই দেওয়া হবে, যাদের এই ব্যাপারে ভাল রকম অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাজেই, নিঃসন্দেহে খাগড়াগড়ে ডেরা বাঁধার অনেক আগেই হাত পাকিয়েছিল শাকিল, সুবহানেরা।”
খাগড়াগড়ের আগে কোথায় তৈরি করা হয়েছিল আইইডি উৎপাদনের সেই কারখানা?
ওই গোয়েন্দা-কর্তা বলেন, “আমরা সেটাই খুঁজে বের করারচেষ্টা করছি। তবে বিশেষ একটিসূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, সম্ভবত মুর্শিদাবাদ জেলায় বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কোনও জায়গাতেই ওই রকম এক বা একাধিক কারখানা তথা গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়েছিল।” ওই কারখানার সম্ভাব্য জায়গা হিসেবে লালগোলা ও বেলডাঙাকে পাখির চোখ করে তল্লাশি চালাচ্ছেন ও খোঁজখবর নিচ্ছেন তদন্তকারীরা।
অন্তত বছর খানেক ধরে এহেন জঙ্গি কার্যকলাপ চললেও সেটা জেলা পুলিশ ও রাজ্য গোয়েন্দা শাখার (আইবি) নজর কী করে এড়িয়ে গেল, সেই প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের অন্দরেই। তাঁদের বক্তব্য, সে ক্ষেত্রে একই ভাবে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো, সেনা গোয়েন্দা ও বিএসএফের গোয়েন্দা শাখাও।
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তা অবশ্য বলেন, “জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-সহ বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা ওই জঙ্গি মডিউল সম্পর্কে আমাদের কাছে খবর ছিল না ঠিকই, তবে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে সম্প্রতি নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও বাংলাদেশ সীমান্তে আমরা নজরদারি অনেকটা বাড়িয়েছি।” ওই পুলিশ কর্তার কথায়, “আমরা এখনও মনে করি, ওই নজরদারি বাড়ানোর ফলেই মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বোমা তৈরির কারখানা সরিয়ে আনা হয়েছিল বর্ধমানের উপকণ্ঠে।”
ধৃত আব্দুল হাকিম এবং দুই মহিলা রাজিয়া ও আলিমার কাছ থেকেই এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলবে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের দাবি, জেরার সময়ে রাজিয়াকে বার বার প্রশ্ন করা হয়েছে, ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও কেন সে জেএমবি-র মতো বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠনের কাজে নিজেকে যুক্ত করতে গেল? তদন্তকারীরা জেনেছেন, ধর্মীয় ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে ও নিয়মিত মাসোহারার বিনিময়েই তাদের এই বিপজ্জনক কাজে সামিল করা হয়।
এক গোয়েন্দা-অফিসারের কথায়, “রাজিয়া বিবিরা বাংলাদেশি নয়।
তার ঠাকুর্দাও নদিয়ার করিমপুরের বাসিন্দা। এর পরেও রাজিয়া কী করে বাংলাদেশের কোনও জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হল, সেটাই প্রশ্ন।” ওই অফিসার জানান, রাজিয়ার স্বামী, বিস্ফোরণে নিহত শাকিল আহমেদ জেএমবি-র সদস্য বলে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। “তবে শুধু স্বামীর সূত্রে নয়, মাসের পর মাস রীতিমতো ক্লাস নিয়ে রাজিয়াদের জেহাদি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। যার পরিণতিতে নাশকতায় সামিল হওয়ার সময়ে রাজিয়ার মাথায় থাকেনি, সে কোন দেশের নাগরিক,” বলছেন ওই অফিসার।
***************
পড়শি রাজ্যেও গিয়েছে ফেরার ইউসুফদের ছবি
নিজস্ব সংবাদদাতা (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
কলকাতা, ১৫ অক্টোবর, ২০১৪,
বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডের সন্দেহভাজনরা দেশের বাইরে পালাতে পারেনি বলেই মনে করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। আশপাশের রাজ্যে গা-ঢাকা দিয়ে থাকাটাও কঠিন করে তুলতে তাঁরা এখন উঠে পড়ে লেগেছেন।
প্রধান অভিযুক্ত মহম্মদ ইউসুফ ফেরার। গা-ঢাকা দিয়েছে আরও ৯ জন। তদন্তে তাদের যে সব ছবি পাওয়া গিয়েছে, তার প্রতিলিপি ইতিমধ্যেই বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা বা উত্তরপ্রদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পাঠানো হয়েছে। সন্দেহভাজনরা কেন দেশ ছাড়তে পারেননি বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা? তাঁদের যুক্তি, দেশের বাইরে পালাতে চাইলে বাংলাদেশেই স্বাভাবিক গন্তব্য হওয়া উচিত এই জঙ্গিদের। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার জঙ্গি দমনে পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)-কে অভিযানে নামানোর ফলেই এ বাংলায় আসতে বাধ্য হয় জামাতের দুষ্কৃতীরা। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বর্ধমান বিস্ফোরণের কথা জেনেছে। ফলে, বর্ধমান কাণ্ডের পরে বাংলাদেশের পুলিশের সামনে গিয়ে পড়তে চাইবে না ইউসুফরা। গোয়েন্দারা জেনেছেন বাংলাদেশের রাজশাহি জেলার আহলে হাদিস ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিই ছিল পালিয়ে গিয়ে ইউসুফদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। কিন্তু, বর্ধমান কাণ্ডের পরে সেখানেও তল্লাশি অভিযান চালান হয়েছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন।
ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, “বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডে যে নামগুলি পাওয়া গিয়েছে, নিয়মমাফিক সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া চলছে। সীমান্ত এলাকাতেও যাতে দুষ্কৃতীরা ঘাঁটি গাড়তে না পারে, তার জন্যও নজরদারি চলছে, যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
তদন্তকারীরা বলছেন, বাংলাদেশ ছাড়া নেপালে পালিয়ে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা ছিল। এর আগে ভারতীয় ভূখণ্ডে নাশকতামূলক কাজের পরে নেপালে পালিয়ে যাওয়ার নজির রয়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন বন্ধুত্বপূর্ণ। তাই সেখানকার পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছ থেকে যথাসম্ভব সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিক অতীতে নেপাল পুলিশের সাহায্য নিয়েই ইয়াসিন ভাটকলের মতো জঙ্গিদের ধরা গিয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন লুকনোর জন্য ইউসুফরা কোনও ধর্মীয় স্থানই পছন্দ করে। নেপালে তেমন সুযোগ অল্প।
গোয়েন্দাদের ধারণা, তাই বেশি দূর যেতে পারেনি ইউসুফরা। নিম্ন অসমের সঙ্গে যে হেতু ইউসুফ-শাকিলদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, তাই অসমে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার দিকটিও খতিয়ে দেখা হয়েছে। সেখানে কড়া নজরদারি শুরু করেছে এনআইএ। জামাতুল মুজাহিদিন জঙ্গিদের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ইতিমধ্যেই অসম থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ফলে অসমে পালিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি হয়তো নেবে না ইউসুফরা। ধরপাকড় শুরু হয়েছে অন্য রাজ্যেও। চেন্নাইয়ে তিন যুবককে আটক করেছে পুলিশ। বর্ধমান কাণ্ডের সঙ্গে তাদের কোনও যোগাযোগ রয়েছে কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শাকিলের মোবাইল কললিস্ট থেকে জানা গিয়েছে, চেন্নাইয়ে সে বেশ কয়েক বার ফোন করেছিল।
এনআইএ-র এক কর্তার কথায়, “ইউসুফরা বিস্ফোরণের পরেও দু’তিন দিন শিমুলিয়ার মাদ্রাসায় ছিল বলে জানতে পেরেছি।” এই তথ্য জানা গিয়েছে ওদের মোবাইল ঘেঁটে। কিন্তু, তার পর থেকেই ইউসুফদের মোবাইল ফোন বন্ধ করা আছে। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, সম্ভবত কোথাও গিয়ে নতুন সিম নিয়েছে পলাতকেরা। কিন্তু, যে ভাবে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, তাতে খুব একটা শান্তিতে নেই তারা।
Read More : West Bengal Police tried to hush up blast cases and destroying evidences
Read More : West Bengal Police tried to hush up blast cases and destroying evidences
No comments:
Post a Comment