তল্লাশি না করে মাদ্রাসায় ঢুকতে দেবেন না পুলিশকে বর্ধমান শহরে এক সমাবেশ থেকে হাজির জনতার প্রতি এই ডাক দিলেন সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী। একই সঙ্গে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে ধৃত রাজিয়া ও আলিমার জন্য চাঁদা তুলে আইনজীবী নিয়োগ করা হবে বলেও জানিয়ে দিলেন তিনি।
সোমবার বর্ধমান শহরের কেন্দ্রে কার্জন গেটের সামনে সম্প্রীতি মঞ্চের নামে ডাকা ওই সমাবেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ নেতা সিদ্দিকুল্লা সরাসরি নির্দেশ দেন, “মাদ্রাসায় পুলিশকে ঢুকতে দেবেন না। পুলিশ, সিআইডি, ডিআইবি এলে দরজা বন্ধ করে রাখুন। আগে পুলিশকে তল্লাশি করুন। তার পরে ভেতরে ঢুকতে দেবেন।”
এই সমাবেশের জেরে এ দিন দুপুরে ঘণ্টা চারেকের জন্য কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে যায় গোটা বর্ধমান শহর। মিছিলে ঢুকে পড়ার অপরাধে বাদামতলা মোড়ের কাছে পুলিশের সামনেই মেরে ভেঙে দেওয়া হয় বীরভূমের নানুর থেকে আসা এক ব্যবসায়ীর গাড়ির কাচ। মারধর করা হয় চালককেও। বর্ধমান থানার আইসি আব্দুল গফ্ফরের দাবি, একটি মিছিলের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। এত বড় সমাবেশ হবে জানলে অনুমতি দেওয়া হত না। আজ, বৃহস্পতিবার এই সমাবেশেরই পাল্টা হিসেবে বর্ধমানে মিছিল করে জেলাশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছে বিজেপি।
যে বর্ধমান শহরে এই সমাবেশ করেছেন সিদ্দিকুল্লারা, তার লাগোয়া খাগড়াগড়ে এক বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করেই এই অঞ্চলে প্রথম সন্ত্রাসবাদের জালের খোঁজ মেলে। সেই তদন্তে নামার কয়েক দিনের মধ্যেই কিছু অনুমোদনহীন মাদ্রাসার দিকে নজর পড়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের। মঙ্গলকোটের শিমুলিয়ার মতো কিছু জায়গায় ‘মাদ্রাসা’ নামের আড়ালে আসলে জেহাদি প্রশিক্ষণ শিবির চালানো হচ্ছিল বলে এনআইএ-র সন্দেহ। বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদে কয়েকটি মাদ্রাসায় ইতিমধ্যে তল্লাশি চালানো হয়েছে। এ দিনও ডোমকলের ঘোড়ামারায় জনমানবহীন একটি মাদ্রাসায় তল্লাশি চালানো হয়। সেখান থেকে কিছু কাগজপত্র ও ফোন নম্বর মিলেছে। যদিও মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকী সন্দেহের বাইরে থাকা অনুমোদনহীন মাদ্রাসার সংখ্যাই কিন্তু বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে সিদ্দিকুল্লার এই আহ্বানের পিছনে রাজনীতির গন্ধই পাচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, সিদ্দিকুল্লার এই সমাবেশের পিছনে তৃণমূলের মদত নেই তো? সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারই বলছেন, “মাদ্রাসা মানেই তো সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি নয়। কিন্তু সব মাদ্রাসাকে এক সুতোয় বেঁধে সিদ্দিকুল্লারা বিভাজনের রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে তৃণমূল। আজকের সমাবেশে ওরাই লোক জুটিয়েছে।”

বক্তা সিদ্দিকুল্লা। ছবি: উদিত সিংহ
তৃণমূল এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। তবু কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যেমন, তৃণমূল আমলে যেখানে সামান্য একটি পথসভা করতেই বহু ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনের অনুমোদন পান না বিরোধীরা, সেখানে সিদ্দিকুল্লারা শহরের কেন্দ্রে এ দিনের সমাবেশের ছাড়পত্র পেলেন কী ভাবে? সিদ্দিকুল্লা নিজে এই মুহূর্তে সরকার-বিরোধী শিবিরেরই ঘনিষ্ঠ। সদ্য বামেদের সঙ্গী হওয়া পিডিএস নেতা সমীর পুততুন্ডও ছিলেন এই সমাবেশে। কারও কারও বক্তব্য, বিরোধী-ঘনিষ্ঠ নেতাদের সমাবেশকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছে তৃণমূল। সিদ্দিকুল্লা পুলিশের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেও তাঁর আদত লক্ষ্য কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাবাহিনী। কারণ, আজ পর্যন্ত খাগড়াগড়-সহ কোথাওই পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মাদ্রাসায় ঢোকেনি। সুতরাং তাদের আটকানোর কথা বলা তো সে দিক থেকে অর্থহীন। অথচ সিদ্দিকুল্লা বলেছেন, “পুলিশের লাঠি চালানো জেরেই বুদ্ধবাবুদের পতন হয়েছে। পুলিশ মাদ্রাসায় গেলে তৃণমূলেরও পতন হবে।” তার পরেই তাত্‌পর্যপূর্ণ ভাবে তিনি উল্লেখ করেন, “আমরা এখনই মমতার পতন চাই না। কিন্তু মনে রাখবেন, নন্দীগ্রামে আমরা লড়াই করেছিলাম। তাতেই রাজ্যের রাজনীতি এ-দিক ও-দিক হয়ে গিয়েছে। আবার যদি আমরা সেই ভূমিকা পালন করি, তৃণমূলও দ্রুত পতনের দিকে এগিয়ে যাবে।” খাগড়াগড় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কেন ১৭ দিন পরে বিবৃতি দিলেন, তা নিয়ে আক্ষেপ করে সিদ্দিকুল্লার হুঁশিয়ারি, “মমতা যেন ঠিক মতো পুলিশকে ব্যবহার করেন। না হলে কিন্তু সেটাই চরম বিপর্যয়ের কারণ হবে।”
জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব সিদ্দিকুল্লার এই বক্তৃতাকে বিশেষ পাত্তা দিতে চাননি। তৃণমূলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) তথা রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, “তদন্ত চলছে। কে কী বলল, কিছু আসে যায় না।” কিন্তু যে ভাবে তিনি বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে বিরোধীরা প্রচ্ছন্ন মদতেরই ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। বিশেষ করে পুলিশ যেখানে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “আমরা খবর পেয়েছি, সিদ্দিকুল্লা প্রচুর উস্কানিমূলক কথা বলেছেন। পুলিশ সম্পর্কে নানা আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে। আমরা ওই সভার রেকর্ডিং জোগাড় করে খতিয়ে দেখছি। সত্যিই যদি দেখা যায়, এই ধরনের কথাবার্তা বলা হয়েছে, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সমাবেশ চলাকালীন এই গাড়িতেই লাঠি দিয়ে মারা হয় বলে অভিযোগ। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র
শুধু পুলিশকে তল্লাশিই নয়, গত ২ অক্টোবর খাগড়াগড়ের বাড়িতে বিস্ফোরণের পরে বমাল ধৃত রাজিয়া ও আলিমা বিবিরও পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন সিদ্দিকুল্লা। এ দিন তিনি বলেন, “গ্রেফতার হওয়া দুই মহিলার জন্য আমরা আইনজীবী নিয়োগ করব। আইনজীবীর মাধ্যমে আমরা জানার চেষ্টা করব, খাগড়াগড়ে ঠিক কী ঘটেছিল। জেলা পুলিশ, সিআইডি, এনআইএ ওদের জেরা করেছে। কিন্তু আমরাও আসল ঘটনা জানতে চাই।” আইনজীবী নিয়োগের জন্য অর্থসাহায্য করার আবেদনও জানান তিনি।
সিদ্দিকুল্লা চড়া সুরে বক্তৃতা দিলেও সমাবেশে সম্প্রীতির বার্তাবাহী বহু পোস্টারই দেখা গিয়েছে। সমীর পুততুন্ডও আবেদন জানান, “শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে দলমত নির্বিশেষে এক হতে হবে।” কিন্তু সদ্য বামে ফেরা সমীরবাবু কেন এই সমাবেশে ছিলেন, তার কোনও জবাব অবশ্য মেলেনি।


Burdwan Blast - Shown West Bengal now is the safest place for terrorists