কখনও নিষ্ক্রিয়। কখনও অতি-সক্রিয়। পাড়ুইয়ে গত ক’দিনের ঘটনা পুলিশের এই দ্বৈত ভূমিকাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
সোমবার তৃণমূলের শতাধিক দুষ্কৃতী মাখড়া গ্রামে ঢুকে তাণ্ডব চালায় বলে অভিযোগ। তখনও ছিল ১৪৪ ধারা। গ্রামের ভিতরে ঢোকেনি পুলিশ। প্রশ্ন উঠেছিল, কী করে ১৪৪ ধারা থাকা সত্ত্বেও দুষ্কৃতী-তাণ্ডব চলল? কেনই বা পুলিশ হাত গুটিয়ে রইল?
সেই বীরভূম জেলা পুলিশই চূড়ান্ত সক্রিয়তা দেখাল বুধবার। মাখড়ায় ঢোকার আগে আটকে দেওয়া হল এ রাজ্যের তিন বিরোধী দলের নেতাদেরই! এবং তা করা হল সেই ১৪৪ ধারার যুক্তি দেখিয়েই! চাপ বাড়াতে বৃহস্পতিবার বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল মাখড়া যাবে। বিরোধীরা তো বটেই, পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন গ্রামবাসীরাও। শেখ আজমল, লড়াই বাউরি, নাজমা বিবিরা এ দিন স্পষ্ট বলেছেন, “বিরোধী নেতারা তো বোমা-গুলি নিয়ে আসেননি! অথচ পুলিশ তাঁদের ঢুকতে দিল না। হামলার সময় এই বীরত্ব কোথায় ছিল?”
রাজ্য প্রশাসনের যুক্তি, এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এবং নিয়ম মেনেই বিরোধী প্রতিনিধিদলকে গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এক সময় সিঙ্গুরে বিক্ষোভ-আন্দোলন এড়াতে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। সিঙ্গুরে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধা পেয়ে তত্‌কালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় ফিরে আসতেই আরাবুল ইসলামরা বিধানসভার লবিতে ভাঙচুর চালিয়েছিলেন! এক বিজেপি নেতার কটাক্ষ, “সেই সময় মমতা ১৪৪ ধারার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন, আজ তাঁর পুলিশ একই কাণ্ড ঘটাচ্ছে!”
এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ হাঁসড়া স্কুলমোড়ে পৌঁছেছিল সাংসদ অভিজিত্‌ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের দল। ছিলেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মিও। অভিজিত্‌বাবু বোলপুরের এসডিপিও সূর্যপ্রতাপ যাদব ও সিআই (বোলপুর) চন্দ্রশেখর দাসের কাছে জানতে চান, কী কারণে তাঁদের আটকানো হচ্ছে। এসডিপিও বলেন, “১৪৪ ধারা আছে। ওখানে গেলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। আপনাদের নিরাপত্তার জন্যই আটকানো হচ্ছে।” অভিজিত্‌বাবু পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, “তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা যখন মাখড়ায় হামলা চালিয়েছিল, তখন ১৪৪ কোথায় ছিল?” এর পরেই পুলিশের সঙ্গে বচসা বাধে। রাস্তায় বসে পড়েন কংগ্রেস নেতারা। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে অবস্থান-বিক্ষোভ চলে তাঁদের।
পুলিশের বাধায় মাখড়া গ্রামে ঢুকতে না পেরে হাঁসড়া
মোড়ে অবস্থান কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের।—নিজস্ব চিত্র।
দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ বাম প্রতিনিধিদল প্রথমে আসে চৌমণ্ডলপুরে। দলে ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমান-সহ দশ জন বিধায়ক, সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন সাংসদ রামচন্দ্র ডোম। গ্রামে ঢোকার মুখে তাঁদেরও আটকে দেয় পুলিশ। সেই সময় গ্রামের জনা কুড়ি মহিলা দৌড়ে চলে আসেন। পুলিশ-কর্তাদের সামনেই বাম নেতাদের তাঁরা বলেন, “চার-পাঁচ দিন ধরে আমরা পুুলিশের ভয়ে গ্রামছাড়া। খাওয়া জুটছে না। পুলিশ গ্রামের নলকূপগুলো পর্যন্ত ভেঙে দিয়েছে!”
এ দিন মাখড়ার প্রাথমিক স্কুলে অস্থায়ী ক্যাম্প বসলেও এলাকায় আতঙ্ক কাটেনি। তল্পিতল্পা নিয়ে গ্রাম ছেড়েছেন অনেকে। মসলিমা বিবি, শরিফা বিবি, খুরজান বিবিদের প্রশ্ন, “এই পুলিশের উপরে কোনও ভরসা নেই। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই মহিলা। এখানে আমাদের কী করুণ অবস্থা, তা কি তিনি জানেন না?”
শেষে বাম নেতাদের হাঁসড়া মোড় পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দেয় পুলিশ। সেখানে ফের তাঁদের আটকানো হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়ে দেন এসডিপিও। ঋতব্রত বলেন, “আমরা জনপ্রতিনিধি। আমরা বোমা নিয়ে যাচ্ছি না। আপনাদেরকে বোমা মারার কথাও বলছি না!” ঋতব্রতর কথায়, “১৪৪ ধারার মধ্যেই গুলি-বোমা চলল। এখন সেই পুলিশই কত সক্রিয়!” পুলিশ বাম নেতাদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। কিন্তু বাম নেতারা জামিনের বন্ডে সই করতে রাজি না হওয়ায় তাঁদের নিঃশর্ত জামিন দেওয়া হয়।
হাঁসড়া মোড়ে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি বাম প্রতিনিধি দলের।—নিজস্ব চিত্র।
এই সময়েই হাঁসড়া স্কুলমোড়ে শিশির বাজোরিয়া, সুকান্ত মুখোপাধ্যায়, শর্মিষ্ঠা কর পুরকায়স্থ, মহম্মদ আরশাদ আলম ও প্রভাকর তিওয়ারিকে নিয়ে চলে আসে বিজেপি-র দল। পুলিশের সঙ্গে তাঁদেরও বচসা বাধে। শিশিরবাবু বলেন, “আমরা দু’জন যাব। দু’জন গেলে তো ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন হবে না!” পুলিশকর্তারা জানিয়ে দেন, গ্রামে গেলেই উত্তেজনার সৃষ্টি হবে। পরে শিশিরবাবু কটাক্ষ করে বলেন, “পুলিশ নিশ্চয়ই নবান্ন থেকে নির্দেশ পায়নি! তাই এ ভাবে আটকে দিল!” বিজেপি-র আইনজীবী কৌশিক চন্দ্র এ দিন জানিয়েছেন, মাখড়ায় সিবিআই তদন্ত, ঘরছাড়াদের ফেরানো এবং ক্ষতিপূরণের দাবিতে এ দিন হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে। আজ, বৃহস্পতিবার পাড়ুইয়ে আসছে মুখতার আব্বাস নকভির নেতৃত্বে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল। তাঁরাও বাধা পান কি না, সেটাই দেখার।

আরও - 
Bengal cops attacked with bombs when they raid suspect village