Saturday, October 4, 2014

Mamta and her insensitive politics made Jadavpur University problem worse

প্রবন্ধ ১

এই সমস্যা সামলাতে এমন ধুন্ধুমার কাণ্ড!

দীপেশ চক্রবর্তী

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
(সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)






‘কোনও এক ন্যায়বোধ’। 

যাদবপুরের কাণ্ডের প্রতিবাদে। 

 কলকাতা, ২০ সেপ্টেম্বর। ছবি: প্রদীপ সান্যাল

যাদবপুর কাণ্ডে অনেক কথা উঠেছে। তার মধ্যে খুব বড় একটি কথা নানা রাজনৈতিক চাপান-উতোর, অভিযোগ-অনুযোগকে ছাপিয়ে উঠেছে, সেটা হল, যাদবপুর কাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতায় যে মহামিছিল দেখা গিয়েছিল, তার স্বতঃস্ফূর্ততা। দূর থেকে দেখেও মনে হয়, ছাত্রছাত্রীদের এই প্রতিবাদী সত্তাকে গাঁজা-চরসের গল্প দিয়ে ঢাকা যাবে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরতা যাদবপুরের এক জন প্রাক্তনী তাঁর যাদবপুর-প্রদত্ত স্বর্ণপদক ফিরিয়ে দিয়েছেন; আমার শ্রদ্ধেয় বেশ কিছু শিক্ষকশিক্ষিকা ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন; সহ-উপাচার্য ও দর্শন বিভাগের প্রধান (যথাক্রমে) সহ-উপাচার্যের পদ ও ইসি’র সদস্যপদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছেন। মনে কোনও এক ন্যায়বোধ জেগে না উঠলে তাঁরা এই কাজগুলো কেন করবেন? সুতরাং যাদবপুরের উপাচার্য মহাশয়ের নানান সিদ্ধান্ত যে অনেক মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। এ ক্ষেত্রে ‘বহিরাগত’ বা গাঁজা-চরসের তত্ত্বকে খুবই দুর্বল ব্যাখ্যা মনে হয়।
দেশ থেকে অনেক দূরে বসে যাদবপুরের এই ঘটনার ও পরিচিত আরও অনেক ছাত্রবিক্ষোভের কথা ভাবতে গিয়ে প্রবাসী-আমার স্বভাবতই কিছু তুলনামূলক কথা মনে আসে। তার কয়েকটি কথা আলোচনা করতে চাই। পৃথিবীর তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ব্যক্তিগত ভাবে গভীর। দুটি অস্ট্রেলিয়াতে, একটি আমেরিকায়। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি, কখনও-বা অতিথি অধ্যাপক হিসেবে। এ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন-হেনস্থা বা যৌন-নিগ্রহের ঘটনা, বিশেষত মেয়েদের, কিছু অজানা নয়। যাদবপুরের অশান্তির মূলেও ছিল একটি যৌন-নিগ্রহ সম্পর্কিত অভিযোগ ও তার সুষ্ঠু বিচারের পথে পদ্ধতিগত ও প্রশাসনিক কিছু সমস্যা। কিন্তু তাকে ঘিরে ছাত্রদের মূল অসন্তোষ শহরব্যাপী আন্দোলনের আকার নিয়েছে, তাতে সরকার, রাজনৈতিক নেতা, সাধারণ মানুষ অনেকে জড়িয়ে পড়েছেন। সবটাই বুদ্ধিগ্রাহ্য, অনেকটাই ন্যায়সঙ্গত। পুলিশ দিয়ে ছাত্রছাত্রী পেটানো যে বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি, এটা হয়তো রাজ্য প্রশাসনের অনেকে মানবেন।
কিন্তু আমি ভাবছিলাম: আমার বিশ্ববিদ্যালয়েও তো যৌন হেনস্থার কথা ওঠে। নতুন বছর শুরু হওয়ার মুখে সহকর্মীদের নানান চিঠিপত্রে জানলাম নতুন ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের কিছু ছাত্রী কয়েক জনের নামের একটি তালিকা বিলিয়েছেন, এই বলে যে, এঁরা যৌন-নিগ্রহকারী, এঁদের সম্বন্ধে সাবধান। এই পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয় সমর্থন করেন না, কিন্তু কথাটা বললাম এটা বলতে যে, পশ্চিমী বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন-হেনস্থা একটি বড় ও বাস্তব সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যার মোকাবিলায় কোনও দিন ক্লাস বন্ধ করতে হয়নি (অন্তত এ পর্যন্ত), রাস্তায় নামতে হয়নি, রাজনৈতিক নেতাদের ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ‘দল’ নিতে হয়নি।
তার মানে এই নয় যে, সমস্যার মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয় কিছু করেনি। সত্তরের দশকের নারীবাদী আন্দোলনের ফলে অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকায় ও অন্যান্য উদারনৈতিক-গণতান্ত্রিক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যৌন-হেনস্থার বিষয়ে আইন খুব কড়া। বিশ্ববিদ্যালয়েই সংগঠিত কমিটি আছে, যৌন-নিগ্রহ বা হেনস্থার অভিযোগকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। কোনও মাস্টার যৌন-হেনস্থার অভিযোগে দোষী প্রমাণিত হলে চাকরি যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। প্রত্যেক বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন-হেনস্থার বিরুদ্ধে যা-কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার কপি আমাদের পাঠানো হয়। আশির দশকে অস্ট্রেলিয়ায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম, সেখানে প্রত্যেক শিক্ষককে একটি পুস্তিকা পড়তে হত, তাতে কী ধরনের ভাষা ও আচরণ যৌন-হেনস্থার উত্‌স হতে পারে, তার বিশদ আলোচনা ছিল। দিনে দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন-হেনস্থা নিয়ে আইনের বাঁধুনি শক্ত হয়েছে, সেই অনুসারে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। ফলে মাস্টার ছাত্রছাত্রী কর্মচারী সকলের ভয় যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, এ ব্যাপারে শিক্ষা ও সচেতনতাও বেড়েছে। যাদবপুরের ছাত্রীটির যে নিগ্রহ হয়েছিল বলে অভিযোগ, তা আজ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে মূলত প্রশাসনিক ভাবে সমস্যার মোকাবিলা করা হত। ব্যাপারটা ক্লাস-বয়কট, শহরের রাজনীতি, পুলিশ কমিশনারের ব্যাখ্যা এত দূর পৌঁছত না।
স্পষ্টতই, যাদবপুর কাণ্ডের মূলে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক শোচনীয় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতায় যেমন ব্যক্তিবিশেষের দায়িত্ব আছে, তেমনই প্রাতিষ্ঠানিক অস্বচ্ছতারও একটি ভূমিকা আছে। পুলিশবাহিনী ডাকা কি উপাচার্যের একক সিদ্ধান্ত ছিল? অন্তত সহ-উপাচার্য বলছেন যে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। পুলিশ কমিশনার, যিনি রীতিমত শিষ্টভাষী, তিনিই বা এমন কথা বলেন কেন যার সত্যতা নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে? ছাত্ররা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি তদন্ত কমিটি গঠন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, তখন তার নিষ্পত্তি করার কোনও বিধিবদ্ধ প্রণালী ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ে? এই প্রণালী বিধিবদ্ধ করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ইংরেজিতে যাকে বলে গ্রিভান্স প্রসিজিয়োর তাকে প্রতিষ্ঠিত করা, এগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের একটি ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু এগুলো মূলত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। কর্তৃপক্ষ এই দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে বহন করলে একটি সমস্যা, যা প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়েরই দৈনন্দিন সমস্যার একটি, তা এত বড় আকৃতি ধারণ করে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক জীবনের ধারাবাহিকতার প্রতিবন্ধক হত না।
এই প্রশাসনিক ব্যর্থতাও কেবল প্রাতিষ্ঠানিক কারণে ঘটেনি, এর মূলে আছে আমাদের রাজনীতির প্রকৃতি-পরিবর্তন। ‘রাজনীতি’ বলতে রাজনৈতিক সচেতনতার কথা বলছি না, ছাত্রদের ব্যক্তিগত ভাবে কোনও পার্টির সদস্য হওয়ার কথাও বলছি না। আমি বলছি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কয়েক দশক ধরে যে ভাবে শিক্ষাঙ্গন, আমলাতন্ত্র ইত্যাদিকে দলের করায়ত্ত করতে চেয়েছে, তার কথা। তাকেই বলছি ‘দলীয় রাজনীতি’। শুধু ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে নয়, আজ জীবনের নানান ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শাসক দলের কাছের মানুষ হলে তার সাত খুন মাপ। পূর্বতন ও বর্তমান শাসক দল, দু’ক্ষেত্রেই এটা দেখা গেছে। এই যদি অবস্থা হয়, তা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষই বা তাঁদের নিজস্ব নিয়মসকল বলবত্‌ করবেন কী ভাবে? দোষী শাসক দলের হলে তাঁকে শাস্তি দেওয়া যাবে না অথবা ক্ষমতায় এমন মানুষকে বসাব যিনি আমার লোককে ছোঁবেন না এই অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক সংকট প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
তাই প্রবাসী বাঙালি শিক্ষক হিসেবে দুঃখই হয়। আমি ভাবি, যে ব্যবস্থায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা রুটিন প্রশাসনিক সমস্যা বিচার পেত, পড়াশোনা এতটুকুও বিঘ্নিত হত না, আমার দেশের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করতে এসে একটি ভাল বিশ্ববিদ্যালয়েও তা পায় না কেন? এই বন্ধ্যা অথচ তীব্র দুঃখের বোধ থেকেই ‘এবেলা’ পত্রিকা কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর এক প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তা পড়ে এক কলকাতার বন্ধু যার মননশীলতা ও সৌজন্যবোধকে আমি শ্রদ্ধা করি আমাকে লিখেছেন: ‘আপনি কি ছাত্রদের সেই বিদ্যাসাগর-বর্ণিত গোপাল হতে বলছেন? আমি খুবই হতাশ হয়েছি।’ (বয়ানটি একটু বদলেছি, কিন্তু তাঁর বক্তব্য এই।) এখানে, প্রবাসী শুধু নয়, প্রৌঢ় আমিও মুশকিলে পড়ে যাই ছাত্রদের আমি কী বলব? আমার তো আর ‘ছাত্রদের প্রতি উপদেশ’ গোছের কোনও ভাষা নেই। তা ছাড়া আমার যৌবনে জ্বলন্ত কলেজ স্ট্রিটের আগুনে তো আমিও জ্বলেছি ও তার মাসুল গুনেছি অন্তত দশ-পনেরো বছর। কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে ও নিজের ছাত্র-মাস্টার জীবনের মিলিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি কথা বলতে পারি: কৃষিভিত্তিক সমাজে মানুষ যৌবনেই সংসারে পা রাখতেন, শিল্পসভ্যতার ও তার পরের সমাজে তা করলে নিজেরই ক্ষতি। আমাদের যৌবনকাল যা আমাদের তীব্রতম অনুভূতির সময়, যে সময় মানুষ প্রেম করে, আত্মঘাতী হয়, জিহাদ করে, যুদ্ধে যায়, কবিতা লেখে, যখন নিজেকে সব সময় দাহ্য পদার্থ মনে হয় সেটাই আবার শেখবারও সময়, তা সে প্রাচীন ভাষা-সাহিত্য বা বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে হাতেকলমে কাজ, যা-ই হোক।
যৌবনের এই চরিত্র, সুকান্তর সেই লাইন, ‘আঠারো বছর বয়স কি দুঃসহ’ সব দেশেই সত্যি। ছাত্রছাত্রীরা মিছিলে যাবে, ময়দানে হাঁটবে, প্রতিবাদে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলবে, আবার সেই ছাত্রছাত্রীদের একাগ্রচিত্তে পড়াশোনা করতে হবে শুধু ‘কেরিয়ার’-এর কথা ভেবে নয়, জ্ঞানার্জনের আনন্দের সন্ধানেও। কলকাতায় অনেকের প্রিয় দার্শনিক মিশেল ফুকোর কথা ভাবুন। ১৯৬৮-র উত্তাল প্যারিস তাঁকে অবশ্যই ভাবিয়েছিল, কিন্তু সেই ফুকোই নিজের সম্বন্ধে বলেছিলেন, একনাগাড়ে ১৫ বছর লাইব্রেরিতে কাটিয়েছিলেন, অন্য কিছুর দিকে তাকিয়েও দেখেননি। এটাকে কি ‘গুডি-গুডি’ ছেলে বা ‘গোপাল’ হওয়া বলব?
তাই বলছিলাম: যৌবনের ধর্ম যদি অনুভূতির তীব্রতা হয়, তা সে লড়াইয়ের ময়দান বা লাইব্রেরির পুস্তকারণ্য, যা নিয়েই হোক, তা হলে সমাজের কর্তাদেরই এই ব্যবস্থা করার দায়িত্ব যে, এই যৌবনের অপচয় না হয়। এই দায়িত্ব এক দিকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের, কিন্তু আমাদের দেশে তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক নেতাদের। তাঁরা দলীয় ক্ষুদ্রস্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করলে পশ্চিমবঙ্গে যৌবনের এই অপচয় আটকানো যাবে না। প্রৌঢ় আমার তা নিয়েই দুঃখ হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক

No comments:

Post a Comment