ধর্মের কল অতীতেও বাতাসে নড়িত, এখনও নড়িতেছে। সামান্য তফাত: অতীতে তাহা নড়িত কেবল সিনেমার পর্দাতেই, অধুনা বাস্তবেও সুবাতাস লাগিয়াছে। ফ্যাশন হইতে বাগ্ভঙ্গি, বহু বিষয়েই বাস্তব চলচ্চিত্রের দুনিয়াকে অনুসরণ করিয়া থাকে, অপরাধ ও শাস্তির বিষয়েও তাহা ঘটিলে মঙ্গল। তামিল চলচ্চিত্রের ভূতপূর্ব নায়িকা ও তামিলনাড়ুর সদ্য-প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতা হয়তো সেলুলয়েডের কল্পলোক এবং ধুলার পৃথিবীর এই সমাপতনে মর্মাহত। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই স্মরণ করিতেছেন যে, মামলা এবং দণ্ডাদেশের মধ্যে প্রায় আঠারো বছর কাটিয়া গিয়াছে। বিচারের গতি দ্রুততর হইলে ধর্মের কল দ্রুত নড়িতে পারে। তবে এই মামলায় বাধা সৃষ্টির প্রভূত অভিযোগ এবং সেই বাধা অতিক্রম করিতে মামলা যে ভাবে চেন্নাই হইতে বেঙ্গালুরুতে স্থানান্তরিত করিতে হইয়াছে, তাহাতে মানিতেই হয়, আইন-আদালতের প্রতিষ্ঠানগুলি অনুকরণীয় দৃঢ়তার পরিচয় দিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতি নিবারণ আইন মোতাবেক দণ্ডিত হইলেন, ইহার প্রতীকী তাৎপর্যও অনস্বীকার্য। ক্ষমতার উচ্চপদে থাকিয়া দুর্নীতি করিব এবং পার পাইয়া যাইব— এই নিশ্চিন্ততার অবসান ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও সম্ভাবনার সূচক।
অন্য সূচকও আছে। গত কয়েক বছরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশ জুড়িয়া যে প্রবল প্রতিবাদ এবং প্রতিকারের দাবি ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত, তাহাকে কোনও ভাবেই বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত চেতনা বলিয়া তুচ্ছ করিবার উপায় নাই। ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় দফায় দুর্নীতি গ্রিক উপকথার হাইড্রার মতো ভয়াবহ বহুমুণ্ড আকার ধারণ করিয়াছিল। জনমনে, অত্যন্ত সংগত কারণেই, এই বিশ্বাস উত্তরোত্তর প্রোথিত হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার হাইকমান্ড সেই অসুর দমনে তৎপর না হইয়া চোখ বুজিয়া থাকিয়াছেন। এই ধারণা যে তীব্র বিরাগ উৎপাদন করে, ইউপিএ তথা কংগ্রেসের অভূতপূর্ব নির্বাচনী বিপর্যয়ের পিছনে তাহার ভূমিকা বিপুল। ক্ষমতাবানের দুর্নীতির প্রতি নাগরিক সমাজের এই তীব্র ঘৃণা এবং প্রচলিত রাজনীতির পথে তাহা দূর করিবার বিষয়ে আস্থাহীনতাই আম আদমি পার্টির ধূমকেতু-উত্থান ঘটাইয়াছিল। অরবিন্দ কেজরীবালরা হাতের গদি পায়ে ঠেলিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের ব্যর্থতাই জানাইয়া দেয়, দুর্নীতির নাগপাশ হইতে মুক্তির জন্য নাগরিকরা এমনই মরিয়া যে, প্রশাসনিক সামর্থ্যের পরীক্ষা না লইয়াই তাঁহাদের হাতে রাজধানীর শাসনভার তুলিয়া দিয়াছিলেন।
সত্য বটে, বিহার হইতে উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু হইতে পশ্চিমবঙ্গ, সর্বত্রই আজও দুর্নীতির অভিযোগে আকণ্ঠ নিমজ্জিত দল এবং দলনেতারা বিপুল ভোটে জয়ী হইতেছেন। চার মাস পূর্বে লোকসভা নির্বাচনে তামিলনাড়ুর ঊনচল্লিশটি আসনের সাঁইত্রিশটি দখল করিয়াছিল এআইএডিএমকে। সারদা-আদি কেলেঙ্কারির সহিত পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের নিবিড় হইতে নিবিড়তর সংযোগের সাক্ষ্যপ্রমাণ জমিয়া উঠিলেও সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলিতে তাহার জনপ্রিয়তায় কোনও ভাটার টান দেখা যায় নাই। কোনও রাজ্যেই ভোটদাতারা বলেন নাই, ‘আগে সততা চাই, তাহার পর অন্য কথা।’ ভারতীয় গণতন্ত্রকে এখনও অনেক পথ হাঁটিতে হইবে। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্র তো নিরবচ্ছিন্ন ভাবে জঙ্গম। বলিষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন প্রশাসনের দাবিদার নরেন্দ্র মোদীকে তাঁহারও অভাবিত গরিষ্ঠতা দানের তিন মাসের মধ্যেই তাঁহার দলকে বিভিন্ন উপনির্বাচনে সমান অভাবিত ব্যর্থতা হজম করিতে হইয়াছে। স্পষ্টতই, নির্বাচকরা রাজনীতিকদের ক্রমাগত পরীক্ষা লইতেছেন। নিজেরাও শিখিতেছেন। আশা— তাঁহারা ক্রমশ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে দুর্নীতির মোকাবিলা করিতে শিখিবেন। ধর্মের কল নড়িতেই থাকিবে। আম্মার রাজ্যেও, দিদির রাজত্বেও।


সম্পাদকীয় ২

আইনের শর্ত

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
(সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)

কলিকাতা হাইকোর্টে আবার ধাক্কা খাইল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এ বার হাওড়া ময়দান হইতে রাজারহাট পর্যন্ত বিস্তৃত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রেলের পথ লইয়া। ২০১২ সালে কেন্দ্রের ইউপিএ-২ সরকার হইতে ইস্তফা দেওয়ার পর অর্থাৎ সেই সরকারের রেল মন্ত্রক হাতছাড়া হওয়ার পর রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো হইতেও রাজ্য সরকারের অংশীদারি ছাড়িয়া দেয়। সেই সূত্রে নির্মীয়মাণ এই পাতাল রেলের পথ নূতন করিয়া বিন্যস্ত করার অধিকারও রাজ্য সরকারের থাকার কথা নয়। অথচ এত কাল শিয়ালদহ হইতে মহাকরণ পর্যন্ত পাতাল রেলের প্রস্তাবিত রুট পুনর্বিন্যাসের জেদ ধরিয়া রাজ্য নির্মাণের কাজে ব্যাঘাত ঘটাইয়াছে। হাইকোর্ট পত্রপাঠ সেই বাধা সরাইয়া অবিলম্বে পাতাল রেলের স্থগিত নির্মাণ পুনরারম্ভের নির্দেশ দিয়াছে। বিচারপতি নাদিরা পাথেরিয়া দ্ব্যর্থহীন তিরস্কারে রাজ্য সরকারকে জানাইয়াছেন, তাহার অন্যায় আব্দারের জন্য ইতিমধ্যেই বহু শত কোটি টাকার অপচয় হইয়াছে, আর নয়।
হাইকোর্টের নির্দেশ সঙ্গত। এমনিতেই গঙ্গার নীচে সুড়ঙ্গ কাটিয়া নদীর দুই তীরকে রেলপথে সংযুক্ত করার কাজটি দুরূহ, ব্যয়বহুল ও সময়সাধ্য। তদুপরি রাজ্য সরকারের জেদের কারণে সেই প্রকল্প বিলম্বিত হওয়া এবং ঘুর-পথে পাতাল রেল গড়িতে অতিরিক্ত বারোশো কোটি টাকা গুণাগার দেওয়া অর্থহীন। বিশেষত সরকারের তরফে যুক্তি যখন বউবাজার অঞ্চলকে পাশ কাটাইয়া সেখানকার হকার ও জবরদখলকারীদের স্বস্তি দেওয়া। জবরদখলকারীরা মহানগরীর অধিকাংশ অঞ্চলই বেআইনি ভাবে ব্যবহার করিতেছে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো দখল লইতেছে। তাহাদের খুশি রাখিয়া এই রাজধানী শহরে কোনও নগরোন্নয়ন প্রকল্পই রূপায়ণ করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল যখন কিছু মানুষের অসুবিধার কথা তোলেন, তখন এ জন্যই বিচারপতি অসংখ্য নিত্যযাত্রীর নিত্যযাত্রার নরকযন্ত্রণার পাল্টা যুক্তি দিয়া বলেন, কিছু সুবিধা ও লাভ পাইতে গেলে নাগরিকদের কিছু অসুবিধা ও কষ্ট তো সহ্য করিতেই হইবে। তুলনা টানিয়া বিচারপতির বক্তব্য— কোনও অবোধ শিশু আকাশের চাঁদকে হাতে আনিয়া দিতে বায়না করিতেই পারে, তাই বলিয়া কি বাস্তবে সেটা করা সম্ভব? বিচারপতির এই শ্লেষোক্তি যে রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকেই বিদ্ধ করিবে, তাহাতে সংশয় নাই। কিন্তু ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর রুট পুনর্বিন্যাসের পিছনে এ ধরনের শিশুসুলভ বায়না এবং জেদই সক্রিয় থাকিয়াছে।
একই ধরনের অবোধ জেদ ও বায়না কাজ করিয়াছে আদালতে বিচারাধীন বেশ কিছু মামলায়। সিঙ্গুরে সরকারের অধিগৃহীত এবং টাটা সংস্থাকে লিজ দেওয়া জমি ফেরত পাইতে রাজ্য সরকারের অর্ডিন্যান্স অনিচ্ছুক জমিদাতাদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দরদের সূচক হইতে পারে, কিন্তু দেশের আইন অনুযায়ী তাহা করা যায় কি? অনুব্রত মণ্ডলের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ‘শেষ পর্যন্ত’ যাইতে পারেন, কিন্তু তাহাতে পুলিশকে দিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে নথিভুক্ত খুনের অভিযোগ চার্জশিট হইতে বাদ দেওয়ানো যায় না। যত গরিষ্ঠতা লইয়াই কেহ ক্ষমতাসীন হোন, তাঁহাকে আইন মানিয়াই কাজ করিতে হইবে। আইনে কোনটা সিদ্ধ, আর কোনটা আটকায়, তাহা স্থির করার ভার আদালতের, নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের নয়। কোনও অজুহাত বা যুক্তিতেই আইনবিরুদ্ধ বা অসাংবিধানিক কোনও পদক্ষেপ কোনও জনপ্রিয় রাজনীতিক করিতে পারেন না। তিনি জয়রাম জয়ললিতা হউন কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।