তড়িঘড়ি সুবহানকেই চাঁই বলেছিল এসপি-র রিপোর্ট
সুরবেক বিশ্বাস (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
কলকাতা, ১৩ অক্টোবর, ২০১৪
Burdwan SP, SMH Meerza |
২ অক্টোবর বিস্ফোরণ হয়। বর্ধমানে পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা ৩ অক্টোবর রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি-সহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের একটি প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠান। চার পাতার ওই রিপোর্টের দু’নম্বর পাতার তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “সুবহান মণ্ডল ওরফে স্বপন মণ্ডলের (২৪) বাবার নাম দীপক ওরফে বিপ্লব মণ্ডল। তার সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। তবে সে-ই ছিল দলটির মাথা এবং একই সঙ্গে বোমা, বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী।”
বর্ধমান জেলা পুলিশ সূত্রে খবর, মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে জড়ানো গলায় সুভান জানিয়েছিল, তার বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের উত্তরপাড়ায়। কিন্তু সেই জেলায় ওই নামে কোনও গ্রাম না পেয়ে পুলিশ শেষ পর্যন্ত উত্তরবাড় গ্রামের গোপাল মণ্ডলের বাড়িতে যায়। গোপালবাবুর ছেলে গৌতম বেশ কিছু দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। গৌতমই সুবহান কি না, প্রাথমিক ভাবে সে ধন্দে ছিল পুলিশ। কিন্তু সব জল্পনায় জল ঢেলে বৃহস্পতিবার বাড়ি ফেরেন গৌতম। ফলে, সুবহানের পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই গিয়েছে।
বর্ধমানের পুলিশ সুপার অবশ্য রবিবার দাবি করেন, “প্রাথমিক তদন্তের পরে আমাদের মনে হয়েছিল, সুবহানই ওই চক্রের মাথা। তাই আমরা সেই মর্মে রিপোর্ট দিয়েছিলাম। রিপোর্টে শাকিল বা কওসরের উল্লেখও ছিল। পরে তদন্তে ওদের ভূমিকাটাই সামনে চলে আসে।”
এসপি-র রিপোর্টে উল্লিখিত ওই তথ্যের সঙ্গে কিন্তু এনআইএ এবং সিআইডি-র তদন্তে পাওয়া তথ্য মিলছে না। এনআইএ সূত্রের খবর, সিআইডি তাদের জানিয়েছে, খাগড়াগড়ে হাসান চৌধুরীর বাড়ির দোতলায় জেহাদি জঙ্গিরা একটি পুরোদস্তুর অস্ত্র ও বিস্ফোরকের কারখানা তথা গবেষণাগার চালাচ্ছিল। যার মাথা ছিল বাংলাদেশ থেকে সাত বছর আগে এ দেশে আসা শাকিল আহমেদ। গত ২ অক্টোবর বিস্ফোরণে শাকিল মারা যায়। শাকিলই যে কারখানাটি চালাত, সেটা বিভিন্ন নথি ও তথ্য থেকে এবং ধৃত দুই মহিলা আলিমা বিবি ও রাজিয়া বিবিকে জেরা করে জানা গিয়েছে বলে এনআইএ-কে সিআইডি জানিয়েছে। রাজিয়া আবার শাকিলের স্ত্রী এবং তার তিন সন্তানের মা।
তা ছাড়া, জেহাদি জঙ্গিদের এই নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা মডিউলে কওসরের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে এনআইএ গোড়া থেকেই সন্দেহ করছে। তাদের ধারণা, খাগড়াগড়ে বসে ‘ইমপ্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ (আইইডি) তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক ও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার টাকা শাকিলদের দিয়ে যেত কওসরই। কত আইইডি কোন সময়ে লাগবে, তার বরাতও দিত কওসর এবং আইইডি তৈরির পরে সে-ই ওই বাড়ি থেকে সেগুলি নিয়ে যেত। যেমন নিয়ে গিয়েছিল ১ অক্টোবর, বিস্ফোরণের আগের দিন।
এনআইএ-র বক্তব্য, কারা আইইডি-র বরাত দিত, খাগড়াগড় থেকে আইইডি কোন পথে, কোথায় গিয়ে পৌঁছত এবং কারাই বা এ সবের জন্য বিপুল অর্থের জোগান দিত সে সবই নিশ্চয়ই কওসরের জানা। এই চক্রের শিকড়ে পৌঁছতে কওসর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সে জন্যই তাকে হাতে পেতে পাঁচ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে এনআইএ। কওসরের হদিস দিতে পারলে বা তাকে ধরতে সাহায্য করবে এমন তথ্য দিতে পারলে ওই টাকা পাওয়া যাবে।
তা হলে বর্ধমানের এসপি-র রিপোর্টে যে সুবহান ওরফে স্বপন মণ্ডলকে চক্রের মাথা ও বিস্ফোরক তৈরিতে ওস্তাদ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল, তার সম্পর্কে সিআইডি এবং এনআইএ কী বলছে? এনআইএ সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত যে সব নথিপত্র মিলেছে, তাতে সুবহান মণ্ডলকে পদমর্যাদায় শাকিলের উপরে থাকা কেউ বলে মনে হচ্ছে না। আবার তাদের বক্তব্য, ঘটনার মাস দেড়েক আগে খাগড়াগড়ের ওই আস্তানায় থাকতে শুরু করেছিল সুবহান। বিস্ফোরকের ব্যবহার |বুঝে নিয়ে আইইডি তৈরিতে সুবহান সবে হাত পাকিয়েছিল বলে সিআইডি-র দাবি। তাঁদের অনুমান, সুবহান আরও একটু ধাতস্থ হয়ে যাওয়ার পরে, তাকে দিয়ে নতুন আর একটি গবেষণাগার গড়ে তোলার ছক ছিল শাকিলের।
সে ক্ষেত্রে এসপি-র রিপোর্টে কেন সুবহানকেই চক্রের চাঁই ও বিশেষজ্ঞ বলে উল্লেখ করা হল, সেটাই প্রশ্ন তদন্তকারীদের। এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, “২৪ ঘণ্টার মধ্যে পর্যাপ্ত তথ্য হাতে পাওয়া যাবে না সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সুবহানের নাম তড়িঘড়ি চাঁই হিসেবে উল্লেখ করার কি আদৌও দরকার ছিল?”
আরও পড়ুন - বর্ধমান বিস্ফোরণের তথ্য নষ্ট করল মমতার পুলিশ
***************
সম্পাদকীয় ১ (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
স্মৃতি সত্তা এনআইএ
১৩ অক্টোবর, ২০১৪
গত কাল যাহা অতি পছন্দের ছিল, আজ তাহা দুই চক্ষের বিষ হইতেই পারে। কিন্তু, হঠাত্ মত পাল্টাইল কেন, সেই প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর না দিতে পারিলে সন্দেহ হয়, সেই পরিবর্তন বুঝি বিশুদ্ধ সুবিধাবাদের সন্তান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন ২০১১ সালের মে মাসের পূর্বে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে চরম আস্থাশীল ছিলেন। দেওয়াল হইতে চুন খসিলেই তিনি সিবিআই তদন্তের দাবি পেশ করিতেন। দেখা যাইতেছে, মুখ্যমন্ত্রী হইবার পরই তাঁহার মন বদলাইয়াছে। এখন মৌলবাদী সন্ত্রাসের ন্যায় চরম উদ্বেগজনক ঘটনার তদন্তেও কেন্দ্রীয় দল আসিলে তিনি ফেসবুকে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার দোহাই দিয়া বলেন, ইহা ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত। এনআইএ-র হাতে খাগড়াগড়-কাণ্ডের তদন্ত তুলিয়া দেওয়া যে অসাংবিধানিক নহে, তাহা সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীও অস্বীকার করিবেন না। সংস্থার গঠনতন্ত্রেই এই অধিকার স্বীকৃত। এনডিএ জমানায় সুষমা স্বরাজের নেতৃত্বে যে কমিটি এই অধিকার স্বীকার করিয়া লইয়াছিল, তাহার এক সদস্যার নাম মুখ্যমন্ত্রী হয়তো শুনিয়া বিস্মিত হইবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্পষ্টতই, রাজ্যে যত দিন বাম শাসন ছিল, যুক্তরাষ্ট্রীয়তার প্রতি তাঁহার টান এমন সুতীব্র হয় নাই। নাকি, তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয়তার প্রশ্নটি কখনও বুঝিতেই পারেন নাই? আজ তাঁহার ফেসবুক-মন্তব্য পড়িয়া কেহ মুচকি হাসিয়া বলিতেই পারেন, সুবিধাবাদ। আরও কোনও বড় কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই এই সুবিধাবাদের আশ্রয় লওয়া হইতেছে কি না, এই প্রশ্নও মনে উঁকি দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে একটি নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করা ভাল তাহা ফেসবুকের পাতায় হইলেও। কিন্তু, অবস্থান লইবার পূর্বে জানিতে হয়। নচেত্, হাস্যাস্পদ হইবার ভয় থাকে। ‘কেন্দ্রীয় সরকারকে দেখিয়া বোধ হইতেছে, তাহা যেন একটি রাজনৈতিক দল’ পশ্চিমবঙ্গে তাঁহার সাড়ে তিন বত্সর সরকারের শাসন দেখিবার পর মুখ্যমন্ত্রীর এহেন মন্তব্যে যদি কেহ হাসি চাপিতেও পারেন, রাজ্যে সিবিআই বা এনআইএ পাঠাইবার ফলে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভাঙিয়া পড়িবার আশঙ্কাটি হজম করা মুশকিল। সত্য, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় থাকা প্রয়োজন। কেন্দ্র যাহাতে ‘অভিভাবক’ না হইয়া উঠে, তাহাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু, এই কথাগুলি সিঙ্গুর-কাণ্ডের সময় যতখানি সত্য ছিল, খাগড়াগড়-কাণ্ডের সময়ও ঠিক ততখানিই। আর, কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্কটিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বৈর-সর্বস্ব করিয়াছেন, তাহারও প্রয়োজন ছিল না। সেই সম্পর্কে টানাপড়েন থাকিবে, সংঘাতও কিন্তু মূল সুর হইবে সংহতির। অবশ্য, আমরা-উহারা’র পরিচিত ছকের বাহিরে হাঁটিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভ্যস্ত নহেন।
যুক্তরাষ্ট্রীয়তার পক্ষে রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবতীয় সওয়াল যিনি ধুলায় মিশাইয়া দিতেছেন, তিনি প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের অধিকারের নিজস্ব গণ্ডিটি বজায় রাখিতে গেলে প্রশাসনের মেরুদণ্ড বিসর্জন দেওয়া চলে না। যে প্রশাসন রাজ্যে সন্ত্রাসবাসী মডিউল তৈরি হওয়ার খবর পাইয়াও উদাসীন থাকিতে পারে, এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছাইবার পূর্বে সর্বশক্তিতে প্রমাণ লোপাট করিতে ঝাঁপাইয়া পড়ে, সেই প্রশাসনের ভরসায় যুক্তরাষ্ট্রীয়তা টিকিবে না। দেশের, এবং এই রাজ্যের, স্বার্থেই পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। বাম আমলে পুলিশ নিরপেক্ষ ছিল, এমন দাবি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ধ্বংসাবশেষ হইতেও উঠিবে না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় পুলিশ যতখানি দলদাস হইয়াছে, বামফ্রন্ট ততখানিও পারে নাই। ফেসবুকের দেওয়ালে তিনি যতই বিলাপ করুন, কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই অনিবার্য করিয়াছেন।
No comments:
Post a Comment