ভজাইয়ের ঘরে মুকুলের ‘আসন’, রুইসের বাড়িতে পুলিশের পাহারা
কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও আর্যভট্ট খান
২৪ অগস্ট, ২০১৪, ০১:৩০:৪৮
(সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
লোহা কাটতে লোহা লাগে, তা কে না জানে। কিন্তু সেই লোহার ঠোকাঠুকিতে যে রক্তারক্তি হতে পারে, সেটা অবশ্য অনেকেই বুঝতে পারেন না। যেমন বুঝতে পারেননি রাজারহাট-নিউ টাউনে শাসক দলের নেতারাও।
একের পর এক ইমারত গড়ে ওঠা রাজারহাট-নিউ টাউন কার্যত টাকার খনি। কয়েক গাড়ি বালি-পাথর সরবরাহ করলেই মুঠো মুঠো টাকার সংস্থান। সেই টাকা আয় করতেই দলে দলে সিন্ডিকেট গড়ে মাঠে নেমে পড়েছেন স্থানীয় যুবকেরা। আর সেই যুবকদের নিয়ন্ত্রণ করতেই রাজনৈতিক নেতারা নিয়ে এসেছেন এই সব ‘লোহা’দের। তাদের কারও নাম ভজাই, কারও বা রুইস। কারও নাম সইফুুল, কারও নাম আফতাবউদ্দিন। যদিও সইফুল বা আফতাবউদ্দিন দাবি করেছেন, তাঁরা কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নন।
ওই এলাকায় কান পাতলে এখনও গৌর-রুইসের নাম শোনা যায়। বাম আমলে মহিষবাথানের থাকদাঁড়ি এলাকায় গৌরই ছিল পাণ্ডা। তার অধীনেই ভেড়ি, জমি দখল হত বলে অভিযোগ। লোকে বলে, গৌরের ছত্রচ্ছায়ায় তখন বেড়ে উঠেছিল রুইস-ভজাই। পরে রুইস আলাদা দল গড়ে। গৌরের সঙ্গে বিরোধিতায় ভাগ হয়ে যায় এলাকা। এলাকার সিপিএম নেতা তাপস চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “আমাদের সময়ে ওই রকম কিছু লোক যে ছিল না, তা বলব না। কিন্তু তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের নিয়েই তৃণমূল এখন দাপট দেখাচ্ছে।”
তৃণমূলের একাংশই বলছে, পালাবদলের আগেই তৃণমূলের দিকে ভিড়েছিল ভজাই। ২০১১ সালে নিউ টাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের কাছের লোক হয়ে ওঠে সে। পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলে যোগও দেয় সে। আর সেই গোষ্ঠীর হাত ধরেই এখন সিন্ডিকেট-চক্রের কার্যত মাথা হয়ে উঠেছে ভজাই। তৃণমূলের একাংশই বলছে, ২০১১ সালে ভোটের আগে দলেরই একাংশের বক্তব্য ছিল, ভোটে জিততে ভজাইকেই দরকার। তার সেই দরকারের রূপটাই এখন ফুটে বেরোচ্ছে বলে তৃণমূলের একাংশের ক্ষোভ। যদিও নিউ টাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত ভজাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতেই নারাজ। তাঁর বক্তব্য, “ভজাইয়ের নামে এফআইআর দেখান। তার পরে এ নিয়ে কথা বলব।”
এলাকাবাসী বলছেন, পালাবদলের পরে গৌর-রুইস দু’জনকেই জেলে পুরেছিল পুলিশ। তখন ফাঁকা মাঠে একাই গোল করেছিল ভজাই। লোকবলের অভাবে পুরনো তৃণমূলের লোকেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। দিন যত গিয়েছে, নিউ টাউনের কোণঠাসা নেতারা বুঝেছেন ভজাইকে রুখতে পাল্টা দাওয়াই প্রয়োজন। সেই মতোই জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে দলে টেনে নেওয়া হয় রুইসকে। ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের এক সভায় তৃণমূলের মঞ্চেও দেখা গিয়েছিল রুইসকে। যদিও কাকলিদেবী বলছেন, “রুইস নামে কাউকে চিনি না। কে কী বলছে, আমি জানি না। আমার নামের সঙ্গে কেউ যদি নিজেকে জড়ায়, তার দায় আমার নয়। যদি কেউ কিছু বলে থাকে, তা নিজের দায়িত্বে বলছে।”
রুইস এলাকায় ফিরতেই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল তার দলবল। সক্রিয় হয়েছিল ভজাই-বিরোধী সিন্ডিকেটও। লোহার সঙ্গে লোহার মারামারিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নিউ টাউন। গোলমালের বহরে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন নিউ টাউনের বহুতলের বাসিন্দারাও। লাগাতার এমন ঘটনায় শাসক দলের শীর্ষ নেতারাও বুঝেছিলেন, পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে যাচ্ছে। এর পিছনে যে দলেরই দুই নেতা আছেন, তা-ও বুঝতে ভুল করেননি তাঁরা। গোলমাল মেটাতে দু’পক্ষের নেতাদের নিয়ে বৈঠকও হয়। কিন্তু গোলমাল মেটেনি।
তৃণমূলের একাংশ বলছে, নিউ টাউনে ভজাইয়ের আধিপত্য থাকুক, এটা দলের অনেকেই চান। তাই রুইস গ্রেফতার হলেও ভজাইকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখে পুলিশ। নিউ টাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত বলছেন, “রুইসের মতো দুষ্কৃতীরাই সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করেছিল। সে তৃণমূল কি না, তা আমি জানি না। তবে কোনও নেতা-নেত্রীর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতেই পারে।”
নেতারা যে ভজাইকেও মদত দেন, এলাকায় ঘুরেফিরে পরিষ্কার হয়ে গেল সেটাও। নিউ টাউনের বলাকা আবাসনের পাশ দিয়ে একটি সরু গলি। ঢুকতেই উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গায়ে সবুজ রঙের একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই পাশের একটি বেঞ্চ থেকে এগিয়ে এলেন দুই যুবক। নিজেদের নাম-পরিচয় দিলে তবেই মিলল ভিতরে যাওয়ার অনুমতি।
বাতানুকূল যন্ত্র লাগানো ঘর, ভিতরে সার সার চেয়ার পাতা। এক পাশে বড় টেবিল। ওপারে বিরাট রিভলভিং চেয়ার। পাশে একটু ছোট মাপের আর একটি। আছে ছোট ফ্রিজও! দেওয়ালে ঝুলছে লোকাল বয়েজ সিন্ডিকেটের ক্যালেন্ডার।
একটু পরেই হাজির ভজাই সর্দার। পরনে হাফ শার্ট-লুঙ্গি। ছোট রিভলভিং চেয়ারে বসার পরে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ উঠতেই ভজাইয়ের সাফ কথা, “আমি ও সবে নেই। পাড়ার লোকেরা করে। পাশের ঘরেই ওদের অফিস।” তবে গ্রামের লোকেরা সিন্ডিকেট ব্যবসা করে পয়সার মুখ দেখায় ভজাই খুশি। শাসক দলের সঙ্গে নিজের সুসম্পর্কের কথা জানাতে গিয়ে ভজাইয়ের বক্তব্য, ওই অফিসে বড় রিভলভিং চেয়ারটিতে বসেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। ভজাই ঘনিষ্ঠেরাই বলেন, নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই তার পর থেকে ওই বড় চেয়ারে আর বসেনি ভজাই।
রুইস জেলে। কিন্তু ভজাইয়ের আধিপত্য মেনে নিতে নারাজ ওই এলাকায় সিন্ডিকেট চালানোর আর এক নেতা তথা রাজারহাট-নিউ টাউন তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি আফতাবউদ্দিন। সে রুইস শিবিরের লোক বলে পরিচিত। তৃণমূলের এক অংশের দাবি, দল বদলে আসা ভজাইয়ের এই দাপট মানতে পারছে না সে। “এক দল মাংস-ভাত খাবে, আর এক দল দেখবে এটা হয় নাকি! পাল্টা প্রতিরোধ করতেই নিউ টাউন এলাকায় যাবতীয় গোলমাল বাধছে,” বলছেন নিউ টাউন সংলগ্ন তারুলিয়ার এক তৃণমূল নেতা। আফতাবউদ্দিনের বক্তব্য, “ভজাই পুরো এলাকা দখল করতে চাইছে। এটা হতে দেব না।”
গণ্ডগোল যে সহজে থামবে না, তা আশঙ্কা করেছেন খোদ বিধায়কও। নিউ টাউনের এক তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার পরে সব্যসাচীবাবু বলেন, “শাসক দলের মদত না থাকলে বারবার এই গণ্ডগোল হয় না। এ রকম চললে এই গণ্ডগোল সহজে শেষ হবে না।” অন্য দিকে সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার বলেন, “একটা এলাকায় বারবার অশান্তি হোক, কেউ চায় না। পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে জানব কী নিয়ে এত গণ্ডগোল হচ্ছে। গণ্ডগোল কেন হচ্ছে, তা প্রশাসন বলবে। আমার পক্ষে সব খুটিনাটি জানা কি সম্ভব! ”
গোলমাল পাকানোর অন্যতম কুশীলব বলে অভিযুক্ত রুইসকে সাংসদ চেনেন না বলে দাবি করলেও তৃণমূলেরই একাংশ তার প্রতি সদয় বলে অভিযোগ। রুইস গ্রেফতারের পরে থানায় যান কাকলিও। তবে দলে কাকলি-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এক নেত্রীর কথায়, “রুইসের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ তার স্ত্রী-পরিবারের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করেছিল। তার প্রতিবাদেই কাকলিদি থানায় যান।” এর পর থেকে রুইসের বাড়ির সামনে পুলিশ পাহারা রয়েছে। তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, ভজাইয়ের দলবলের হামলা থেকে বাঁচাতেই এই পাহারা।
No comments:
Post a Comment