সম্পাদকীয় ১ (সৌজন্য- আনন্দবাজার পত্রিকা)
সমাধানের সমস্যা
২৬ অগস্ট, ২০১৪, ০০:০২:০০
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমস্যা ফেলিয়া রাখিতে পছন্দ করেন না। এই বৎসর যেই আলুর দাম বাড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল, তখনই তিনি এক দলা চ্যবনপ্রাশ ঠুকিয়া দেওয়ার পরামর্শ দিয়াছিলেন। অর্থাৎ, গত বৎসর তাঁহার সরকার যে কাজগুলি কিঞ্চিৎ বিলম্বে করিয়াছিল, এই দফায় একেবারে গোড়াতেই সেই কাজগুলি সারিয়া ফেলা গিয়াছে। ভিন্ রাজ্যে আলু চালানের উপর নিষেধাজ্ঞা; সীমান্তবর্তী এলাকায় আলুবোঝাই লরি ধরপাকড়; খুচরা বাজারে আলুর দাম ১৪ টাকায় বাঁধিয়া দেওয়া, সেই নির্দেশ পালিত হইতেছে কি না, দেখিতে প্রশাসনিক নজরদারি; সরকারি আলু বিক্রয় কেন্দ্র সকল ব্যবস্থাই গৃহীত। এই ব্যবস্থায় গত বৎসরও কোনও লাভ হয় নাই, এই বৎসরও হইতেছে না খুচরা বাজারে আলু ২৪ টাকায় বিকাইতেছে। কিন্তু, সে ভিন্ন প্রশ্ন। মুখ্যমন্ত্রী সমস্যা ফেলিয়া রাখিয়াছেন, এমন কথা নিন্দুকেও বলিবে না। সমস্যা মিটিয়া গেলে তাহার আর সমাধানের প্রয়োজন থাকে না, ইহাই বড় মুশকিল। অনুমান করা চলে, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন এই মুশকিলটির কথা মাথায় রাখিয়াছে। নচেৎ, গত বৎসর যে দাওয়াইয়ে কাজ হয় নাই, এই বৎসর ফের সেই একই দাওয়াই হাতে আসরে নামিবার পূর্বে হয়তো কিঞ্চিৎ দ্বিধাবোধ হইত।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন যে লম্ফঝম্প করিতেছে, তাহার অসারতা প্রশ্নাতীত। মিলন মেলা হইতে লরি বোঝাই হইয়া যে বস্তা-বস্তা আলু ভবলীলা সাঙ্গ করিতে ধাপার মাঠে যাইতেছে, তাহা এই আস্ফালনের অসারতার প্রমাণ। সমস্যা খুচরা বাজারের নহে। এমনকী, পাইকারি বাজারেরও নহে। আলু বিপণনের প্রচলিত পদ্ধতির মধ্যেই এই মূল্যবৃদ্ধির ভূত নিহিত। বাজারে ফাটকা খেলিবার সুযোগ থাকিলে সেই সুযোগের অপব্যবহারও হইবে। সমস্যার সমাধান করিতে হইলে সেই ফাটকার অর্থনৈতিক যুক্তিতে আঘাত করিতে হইবে। এই কথাটি শাসক দলের মনঃপূত না হইবারই সম্ভাবনা। আলুর ফাটকায় যাঁহাদের লাভ, অনুমান করা চলে, তাঁহাদের সিংহভাগই ক্ষমতাসীন দলের খাতায় নাম লিখাইয়া রাখিয়াছেন। কাজেই, যেখানে সুবিধা, সেখানেই চাবি খুঁজিবার মোল্লা নাসিরুদ্দিনীয় দর্শনই শাসকদের সহায় হইয়াছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের উপর জবরদস্তিই হউক, বা সরকারি আলু বিক্রয়ের দোকান প্রকৃত প্রস্তাবে সকলই সম্পূর্ণ অবান্তর কালক্ষেপ। অনৈতিকও বটে। খোলাবাজারে নিজের পণ্যের মূল্য স্থির করিবার অধিকার প্রত্যেক ব্যবসায়ীর আছে। বাজারের নিয়ম স্থির করিয়া দিবে, কোন দামে পণ্য বেচিলে ব্যবসায় টিকিয়া থাকা যাইবে। সরকার গায়ের জোরে সেই কাজটি করিতে চাহিলে তাহা সম্পত্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ। গত বৎসর হইয়াছিল, এই বৎসরও হইয়াছে। অনুমান করা চলে, ভবিষ্যতেও হইবে।
পশ্চিমবঙ্গে সার্বিক ভাবে যাহা চলিতেছে, আলুর ক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। আর পাঁচটি বিষয়ের মতোই আলুর মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও সরকারের কোনও স্পষ্ট নীতি নাই। দাম বাড়িলে ঝাঁপাইয়া পড়িব এবং অবান্তর হাত-পা ছুড়িয়া ফের শীতঘুমে চলিয়া যাইব, ইহাকে নীতি বলিলে মুশকিল। অতীতের ভুল হইতে না শিখিবার ধনুর্ভঙ্গ পণটিও অবিকল আছে। জমি অধিগ্রহণ হইতে সিন্ডিকেট রাজ, কোনও ক্ষেত্রেই যেমন অতীত হইতে রাজ্য সরকার শিখে নাই, আলুর ক্ষেত্রেও তাহাই। ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষা করিবার অদম্য তাগিদে পশ্চিমবঙ্গ তাহার সমগ্র শিল্প সম্ভাবনাকে বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দিয়াছে। কর্মসংস্থানের জন্য পড়িয়া আছে কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসামাত্র। আলু বিক্রয়ের মতোই। সরকারি প্রলয়নৃত্যে সেই কাজের পরিবেশও ক্রমে অনিশ্চিত হইয়া উঠিতেছে। যাঁহারা সিন্ডিকেটে নাম লিখাইতে চাহিবেন না বা পারিবেন না, তাঁহাদের অন্নসংস্থানের কোনও উপায় না রাখাই কি প্রশাসনের পণ?
No comments:
Post a Comment