Monday, October 6, 2014

Judiciary is the only hope for common people in India

সম্পাদকীয় ১

দুঃশাসনের ঔষধি

৬ অক্টোবর, ২০১৪ 
(সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)



মানুষ ভাবে এক, হয় আর। দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ও নেত্রীও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নহেন। সত্তরের দশকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী একটি শিষ্ট, সুবোধ বিচারব্যবস্থা চাহিয়াছিলেন। তিনি উহার নাম দিয়াছিলেন ‘কমিটেড জুডিশিয়ারি’। তাঁহার অভিধানে কমিটেড শব্দটির অর্থ ছিল বশংবদ। বিচারপতি নিয়োগ এবং বদলির অধিকারের যথেচ্ছ অপব্যবহার করিয়া তিনি অভীষ্ট পূরণে ব্রতী হন। সাময়িক সাফল্যও আসে। নিতান্ত সাময়িক। জরুরি অবস্থার মেয়াদ দুই বছরও গড়ায় নাই, ভারতীয় গণতন্ত্র সগৌরব প্রত্যাবর্তন করে। ক্রমশ বিচারবিভাগ হৃত সম্মান ও স্বাধীনতা ফিরিয়া পাইতে থাকে। নব্বইয়ের দশকে সেই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, বিচারপতি নিয়োগের অধিকার সম্পূর্ণত বিচারপতিদের করায়ত্ত হয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আদালত প্রশাসনের বিরুদ্ধে কঠোর রায় দিতে থাকেন। ইন্দিরা গাঁধীর অগণতান্ত্রিক উদ্যমে আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগের যে ভারসাম্য বিনষ্ট হইয়াছিল, তাহা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এবং, পেন্ডুলাম বিপরীত মেরুর প্রতি ধাবমান হয়। আদালতের বিভিন্ন রায় প্রশ্ন তুলিতে শুরু করে, বিচারবিভাগ কি আপন স্বাভাবিক এক্তিয়ার অতিক্রম করিয়া শাসনবিভাগ এবং আইনবিভাগের পরিসরে অনুপ্রবেশ করিতেছে? ‘বিচারবিভাগীয় অতিসক্রিয়তা’র অভিযোগ লইয়া তর্ক জমিয়া উঠে।
সেই তাত্ত্বিক তর্ক প্রয়োজনীয়। কিন্তু অস্বীকার করিবার কোনও উপায় নাই, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য, উভয় স্তরেই শাসনবিভাগের কর্তারা বহু ক্ষেত্রে আপন কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন করেন নাই বলিয়াই বিচারবিভাগকে কার্যত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিত্রাতা এবং রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে হইয়াছে। এক দিকে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা বিচারবিভাগকে হস্তক্ষেপে বাধ্য করিয়াছে, যেমন দিল্লিতে দূষণ রোধের জন্য যানবাহনকে সিএনজি ব্যবহারে। অন্য দিকে, রাজনীতিক এবং আমলাদের দুর্নীতি বিস্তৃত হইয়াছে, সরকারি নেতৃত্ব উদাসীন থাকিয়াছেন, প্রশ্রয় দিয়াছেন, এমনকী তদন্তে বাধাও দিয়াছেন। টুজি স্পেকট্রাম হইতে কয়লাখনির ব্লক বণ্টন সংক্রান্ত দুর্নীতি— দৃষ্টান্ত বিস্তর। জয়রাম জয়ললিতার কাহিনি সেই ইতিহাসে সাম্প্রতিকতম সংযোজন। এই কাহিনিগুলি বলিয়া দেয়, বিচারবিভাগকে কেন এক্তিয়ার বিষয়ে ব্যাকরণসম্মত রক্ষণশীলতার সীমা ছাড়িয়া বৈপ্লবিক ভূমিকা গ্রহণ করিতে হয়।
এই প্রেক্ষিতে কলিকাতা হাইকোর্টকে সচরাচর কিছুটা অতিরক্ষণশীল বলিয়া মনে করিবার কারণ আছে। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও প্রশ্ন করা যায়, গত কয়েক বছরে রাজ্য সরকারের অন্যায়ের অভিযোগে আনীত বিভিন্ন মামলায় বিচারপতিরা যে সব নির্দেশ দিয়াছেন, তাহা কি প্রশাসনের ত্রুটি এবং অপরাধের বিচারে যথেষ্ট কঠোর ছিল? এই নির্দেশগুলির ফলে কি সরকারি অনাচার প্রশ্রয় পায় নাই? ইহা সুলক্ষণ যে, সম্প্রতি কয়েকটি ক্ষেত্রে কলিকাতা হাইকোর্টও কঠোর নির্দেশ দিয়াছেন এবং তাহার ফলে দুরাচারী শাসনবিভাগ অন্তত কিছুটা উচিত-শিক্ষা পাইয়াছে। এই কঠোরতা আরও আগে প্রযুক্ত হইলে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের বহুমুখী দৌরাত্ম্য এতটা মাত্রা ছাড়াইত না। আনন্দবাজার পত্রিকা অতীতে বহু উপলক্ষে বিচারবিভাগের অতিসক্রিয়তার সশ্রদ্ধ সমালোচনা করিয়াছে। তাহা অযৌক্তিক নহে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ইতিহাস দেখিয়া মনে হয়, ইন্দিরা গাঁধীর কাঙ্ক্ষিত সুবোধ শিষ্ট বিচারবিভাগ অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অতিসক্রিয় এবং বৈপ্লবিক মনোভাবাপন্ন বিচারবিভাগ গণতন্ত্রের পক্ষে বহুগুণ হিতকর। তাহা না হইলে দুর্বিনীত এবং অনাচারী শাসকরা হাতে মাথা কাটিবার দুঃসাহস পাইয়া যান। শাসন দুঃশাসনে পরিণত হয়।

No comments:

Post a Comment