(সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
খাগড়াগড়ের সেই ঘরে রাজিয়ার স্বামী
শাকিল আহমেদের দেহ।
 ছড়িয়ে রয়েছে এমন সব সরঞ্জাম
যা বিস্ফোরক তৈরির কাজে লাগত,
বলছেন গোয়েন্দারা। ছবি: উদিত সিংহ
বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন-বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে হাত মিলিয়েই ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের (আইএম) একটি গোষ্ঠী বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বোমা ও গোলাবারুদের গবেষণাগার তৈরি করেছিল বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের। বিস্ফোরণস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া একাধিক মোবাইল ফোন ও নথিপত্র ঘেঁটে এবং ধৃতদের জেরা করে এমনই ইঙ্গিত মিলেছে বলে তাঁদের দাবি। ওই গবেষণাগারে এত দিন তৈরি হওয়া বিস্ফোরক কোথায় গিয়েছে, সেটাই আপাতত গোয়েন্দাদের মূল মাথাব্যথা।
গত বৃহস্পতিবার খাগড়াগড়ের ওই বাড়িতে বিস্ফোরণের পরে সেখান থেকে নিহত শাকিল আহমেদের মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করেন গোয়েন্দারা। সেই ফোনের কল লিস্ট ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার একটি নম্বরে যেমন ঘন ঘন ফোন করা হয়েছে, তেমনই নিয়মিত ফোন গিয়েছে মুম্বই, চেন্নাই, কাশ্মীরেও। এমনকী দুবাইতেও ফোন করা হয়েছিল। তা ছাড়া, শাকিলের স্ত্রী রাজিয়া বিবি ওরফে রুমি জেরায় তাঁর স্বামীর সঙ্গে জেএমবি-র যোগাযোগের কথা কবুল করেছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে দাবি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে বাংলায় ছাপা জেহাদ বিষয়ক যে সব কাগজপত্র উদ্ধার হয়েছে, সেগুলিও বাংলাদেশ থেকে আনা বলেই তদন্তকারীদের একাংশের সন্দেহ।
খাগড়াগড়ের ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগসূত্র মোটামুটি ভাবে স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেই যে প্রশ্নটা গোয়েন্দাদের সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে তা হল, সেখানে তৈরি বোমা বা আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) কোথায়, কাদের হাতে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার বিস্ফোরণের পরে ওই বাড়ি থেকে ৫৫টি দেশি হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার করেছিল পুলিশ। অতীতে বাংলাদেশে জেএমবি-র ঘটানো নাশকতায় ব্যবহৃত বিস্ফোরকের সঙ্গে খাগড়াগড়ে উদ্ধার হওয়া ওই হ্যান্ড গ্রেনেডের কিছুটা মিল পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, ২০০৫-এর অগস্টে বাংলাদেশের ৩০০টি জায়গায় ৫০০টি বিস্ফোরণ ঘটানোর অভিযোগ উঠেছিল জেএমবি-র বিরুদ্ধে। সেই সময়ে কম তীব্রতার বিস্ফোরণ (লো ইনটেনসিটি ব্লাস্ট) ঘটাতে সক্ষম এই ধরনের আইইডি-ই ব্যবহার করা হয়েছিল।
খাগড়াগড়ে ধৃত দুই মহিলা রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবিকে জেরা করেও প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক কলকাতা থেকে কিনে বর্ধমানে নিয়ে যাওয়া হতো। তার পরে খাগড়াগড়ে তৈরি করা হতো আইইডি, গ্রেনেড। সেই আইইডি প্রথমে বস্তায় ভরে মোটরবাইকে চাপিয়ে কিছুটা দূরে নিয়ে গিয়ে তোলা হতো ছোট ছোট মোটর ভ্যানে। তার পরে বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছে ভ্যানরিকশায় তুলে তা সীমান্তরক্ষীদের নজর এড়িয়ে ও-পারে নিয়ে যাওয়া হতো। আইইডি-র গন্তব্য মূলত ছিল রাজশাহী।
কিন্তু বাংলাদেশে নাশকতার জন্য পশ্চিমবঙ্গে আইইডি তৈরি হচ্ছে কেন?
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, ন’বছর আগে বাংলাদেশে হওয়া নাশকতাই দেখিয়ে দিয়েছে, জেএমবি-র হামলায় এক সঙ্গে বহু আইইডি-র প্রয়োজন। কিন্তু সে দেশে বিস্ফোরক তৈরি করা যে এখন বিস্তর ঝুঁকির, সে কথা জানিয়েছে ধৃতরা। বাংলাদেশে এক বার ধরা পড়লে দ্রুত বিচারপর্ব শেষ করে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে এই ধরনের অপরাধীদের। না হলে পুলিশের গুলিতে মারা পড়ছে জেহাদিরা। সে জন্যই পশ্চিমবঙ্গকে বেছে নেওয়া হয়েছে। খাগড়াগড় থেকে নদিয়া হয়ে অল্প সময়েই বাংলাদেশে ঢুকে পড়া যায়।
তবে ঠিক কোন পথে বিস্ফোরক বাংলাদেশে যেত, তা জানতে পলাতক কওসরকে হাতে পাওয়া জরুরি বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। বিস্ফোরণের আগের দিনও এই কওসর-ই নম্বর প্লেটহীন লাল রঙের একটি বাইকে করে খাগড়াগড়ের ডেরা থেকে আইইডি নিয়ে গিয়েছিল বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন। তাঁদের সন্দেহ, শাকিলের মতো কওসরও বাংলাদেশের নাগরিক। মঙ্গলকোটের বাসিন্দা, পেশায় মাদ্রাসা শিক্ষক আবদুল কালামকেও ওই ঘটনায় খোঁজা হচ্ছে। 
পাশাপাশি, সব বিস্ফোরক সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে গিয়েছে, না ভারতেই মজুত রয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে না-পারায় সীমান্তবর্তী সব থানাকে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তারা। এই ব্যাপারে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সঙ্গেও সমন্বয় রাখা হচ্ছে।
তবে সবটুকু বিস্ফোরক বাংলাদেশে পাচার না-হয়ে এ দেশেও নাশকতার কাজে লাগানোর ছক থেকে থাকতে পারে, এমনটা ধারণা তদন্তকারীদের একাংশের। তাঁদের বক্তব্য, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গা-সহ ভারতের বিভিন্ন বড় শহরে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য বেশ কিছু আইইডি মজুত করা হয়ে থাকতে পারে। এর কারণ হিসেবে গোয়েন্দারা বলছেন, অল্প দিনের ব্যবধানে ইয়াসিন ভটকল, তেহসিন আখতারের মতো আইএমের শীর্ষ নেতারা ধরা পড়েছেন। এর বদলা  নিতে এবং সংগঠন ফের চাঙ্গা করতে আইএম ভারতের বড় শহরগুলিকে নিশানা করে বড়সড় কোনও নাশকতার ছক কষছে বলে গত কয়েক মাস ধরে বার বার সতর্ক করছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)।
খাগড়াগড় কাণ্ডের কুশীলব ও আড়কাঠিদের আইএম টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে বলেও গোয়েন্দাদের একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে। প্রথমে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, তার পর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে আস্তানা তৈরির পিছনে আইএমের ‘স্লিপার সেল’-এর কয়েক জন সদস্য সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, ওই সদস্যরা এক সময়ে সিমি (স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া)-র সঙ্গে যুক্ত ছিল।
আইএম অতীতে যে সব নাশকতা ঘটিয়েছে, সে ক্ষেত্রে কতগুলি বৈশিষ্ট্য দেখেছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, ওই সব ক্ষেত্রে তাদের সদস্যরা কেউ পড়শি দেশ থেকে বিস্ফোরক জোগাড় করেছে, কেউ সেই বিস্ফোরক সীমান্ত পেরিয়ে নিয়ে এসে কোনও চাঁইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে। কেউ আইইডি তৈরি করেছে এবং অন্য কোনও দল তা ব্যবহার করেছে। আইইডি তৈরির অল্প সময়ের মধ্যে তা ব্যবহার করাই আইএমের বৈশিষ্ট্য। গোয়েন্দাদের একাংশের অনুমান, আইএমের নজর সম্ভবত কলকাতার দিকে ছিল। কারণ বর্ধমানের একশো কিলোমিটারের মধ্যেই কলকাতা আর সেখানে নাশকতা ঘটালে হইচই বেশি হবে।
গোয়েন্দাদের অনেকের আবার আশঙ্কা, কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গায় তো বটেই, ভারতের বেশ কিছু বড় শহরে একই দিনে একই সঙ্গে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটানোর লক্ষ্যে আইএমের হাতে ইতিমধ্যেই খাগড়াগড়ের গবেষণাগারে তৈরি আইইডি পৌঁছে গিয়ে থাকতে পারে। তাঁদের বক্তব্য, বর্ধমান থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রেনে যাওয়া সহজ। খাগড়াগড়ের ওই ডেরা থেকে বর্ধমান স্টেশনের দূরত্ব মাত্র দু’কিলোমিটার।
আইবি-র এক কর্তার কথায়, “এক সঙ্গে ভারতের পাঁচ-ছ’টি শহরে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটালে তা আইএমের বড় সাফল্য বলেই গণ্য হবে। তাই খাগড়াগড়ে তৈরি আইইডি আইএমের হাতে পৌঁছয়নি, এটা এখনই বলা যাবে না।” ওই অফিসার জানান, একটি আইইডি-র বিস্ফোরণের ধাক্কাতেই নিহতদের হাত-পায়ের আঙুল ও শরীরের বিভিন্ন জায়গার মাংস উড়ে ছাদের গায়ে আটকে গিয়েছে! ঘরে থাকা একটি লোহার আলমারি দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন গজাল দিয়ে সেটির গায়ে অসংখ্য ছিদ্র তৈরি করেছে! এ থেকেই বোঝা যায়, কতটা শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরি করা হচ্ছিল ওখানে। আর ওই ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করে একাধিক বড় শহরে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হবে বলেই ওই অফিসারের মত।
এ বছরের জুলাইয়ে মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়াকে পাঠানো হুমকি চিঠিতে বলা হয়েছিল, গাজায় ইজরায়েলি হানার বদলা নিতে মুম্বইয়ে জঙ্গি হামলা হবে। খাগড়াগড়ের ডেরা থেকে সংবাদপত্রে এই সংক্রান্ত প্রতিবেদনের ১৬টি কাটিং মিলেছে।
তবে খাগড়াগড়ের ওই গবেষণাগারে নাইন এমএম পিস্তলের গুলি কাদের জন্য তৈরি হচ্ছিল, তা নিয়ে গোয়েন্দারা ধন্দে পড়েছেন। ধৃত মহিলারা জানিয়েছেন, খাগড়াগড়ের ডেরায় নাইন এমএম পিস্তলের গুলি তৈরি করা হতো। এই সংক্রান্ত কাগজপত্র ও গুলি তৈরির পদ্ধতি সম্বলিত ভিডিও টেপ-ও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছে।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, জেএমবি-র সদস্য, সাত বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে আসা বাংলাদেশের নাগরিক শাকিল আহমেদ-ই জেহাদি প্রশিক্ষণ দিয়েছিল স্বপন মণ্ডল ওরফে সুভান, আবদুল হাকিম এবং রাজিয়া ও আলিমাকে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোনের চিপে ৯/১১-র হামলার ভিডিও রেকর্ডিং মিলেছে। হাকিমকে খাগড়াগড়ের ওই ডেরায় আইইডি তৈরির কাজে সাহায্য করার জন্য রাখা হয়েছিল। বিস্ফোরণ হওয়ার অব্যবহিত আগে কিছু নিতে উঠেছিল হাকিম। তাই বিস্ফোরণের ধাক্কা সরাসরি তার গায়ে লাগেনি বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা। গুরুতর জখম হলেও হাকিম এখনও জীবিত। তাকে জেরা করলে আরও অনেক তথ্য মিলবে বলে আশায় গোয়েন্দারা।


Read More: Mamta party TMC involved in Burdwan Blast case!