ধূপগুড়ির তদন্তে সর্বত্র ‘ছায়াসঙ্গী’ তৃণমূল
Saturday, 06 September 2014 12:31 PM
এ যেন ফুটবলের মতো ‘ম্যান মার্কিং’। যেখানে মৃত ছাত্রীটিকে নিয়ে সভা, আলোচনা বা তদন্ত, সেখানেই পৌঁছে যাচ্ছেন তাঁরা। বোঝানোর চেষ্টা করছেন: ধর্ষণ-টর্ষণ কিছু হয়নি, এ নিছকই আত্মহত্যা। স্কুলের শোকসভায় শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তাঁরা হাজির। আবার তদন্তকারীদের প্রশ্নের জবাব দিতেও সকলকে হটিয়ে তাঁরাই অগ্রণী।
‘তাঁরা’ এলাকায় তৃণমূলের নেতা-কর্মী বলে পরিচিত।
ধূপগুড়িতে সালিশি সভার জেরে দশম শ্রেণির ছাত্রীকে গণধর্ষণ ও খুনের অভিযোগের তদন্তে সর্বত্র পরিস্থিতির রাশ নিজেদের হাতে রাখতে তৃণমূলের একাংশ এমনই তৎপর বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারাই।
নিহত ছাত্রীর পরিবার আগেই অভিযোগ করেছিল, দেহ মেলার পর তৃণমূলের উপ-পুরপ্রধান তাঁদের বাড়িতে এসে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। আজ এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করলেন, এ দিন সকালে রেল লাইনের ধারে ঘটনাস্থলে গিয়ে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা যখন আশেপাশের লোকজনকে প্রশ্ন করছিলেন, তখন সকলকে ঠেলে সরিয়ে সব কথার জবাব দিয়েছেন এলাকার কয়েক জন তৃণমূল নেতা।
যা দেখেশুনে ধূপগুড়ির কেউ কেউ বলেই ফেলছেন, সামনে হাজির থেকে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে তৃণমূল। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের থেকেও তো এ ভয়ানক ঘটনা!
অভিযুক্তদের আড়াল করতে যে চাপ দেওয়া হচ্ছে, সে কথা এ দিনও নিহত ছাত্রীর পড়শিদের একাংশ জানিয়েছেন। তাঁরা জানান, মঙ্গলবার ভোরে মেয়েটির দেহ উদ্ধার হয়। আর সে দিন থেকেই ‘তাঁদের’ আনাগোনা বেড়ে গিয়েছে। পড়শিদের অনেকেই জানিয়েছেন, মঙ্গলবার মেয়েটির দেহ উদ্ধারের পরে পরিবারের সদস্যদের বয়ান নিতে বাড়িতে আসেন ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের অধিকারিকরা। তখন উঠোনে মোড়া পেতে শাসক দলের এক নেতা ঠায় বসেছিলেন। ওই নেতার নাম ধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্তদের তালিকাতেও রয়েছে। ছাত্রীর মায়ের বয়ানের সময়ে তিনি বারবার বাধা দেন বলেও অভিযোগ। এমনকী, পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে মৃতা ছাত্রীর নাম জড়িয়ে বদনাম করার চেষ্টাও চলছে বলে পরিবারের তরফেই অভিযোগ করা হয়েছে।
ওই ছাত্রীটি যে স্কুলে পড়ত, সেখানকার শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই জানান, মঙ্গলবারই স্কুলে হাজির হয়েছিলেন এলাকার কয়েক জন্য তৃণমূল কর্মী। তাঁরাই স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানান, ঘটনাটি ‘নিছক আত্মহত্যা’। সেই মতো স্কুলে শোকসভা শুরু হয়। শিক্ষকরা জানান, সেই শোকসভায় ছাত্রদের ভিড়ে দেখা যায় এক তৃণমূল নেতাকে। তাঁর সঙ্গে শাসক দলের কয়েক জন কর্মীও ছিলেন আগাগোড়া। এর পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজেরা জিজ্ঞাসাবাদ করে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ জানতে পেরে পরদিন ছাত্রীর বাড়ি যান। বৃহস্পতিবার, স্কুলের পড়ুয়া এবং শিক্ষকরা দোষীদের শাস্তির দাবিতে ধূপগুড়ি থানায় লিখিত দাবি জানান।
নিচুতলার কর্মীরা যখন এ ভাবে ‘ম্যান মার্কিং’ করে চলেছেন, জেলা নেতৃত্বও তখন জোর গলায় দাবি করছেন, এটা আত্মহত্যাই। তৃণমূলের জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী এ দিন এক সভায় দাবি করেন, “আলিপুরদুয়ার বা জলপাইগুড়ি জেলায় এই ধরনের ঘটনা (অর্থাৎ ধর্ষণ) হয় না।” এটাকেও পুলিশের উপর চাপ বাড়ানোর কৌশল বলে মনে করছেন অনেকে।
ধূপগুড়ির বাসিন্দারা অনেকেই বলছেন, ধর্ষণ ও খুনের এই মামলায় মূল অভিযুক্তদের মধ্যে যে হেতু শাসক দলের এক কাউন্সিলরের স্বামী এবং তাঁর অনুগামীরা রয়েছেন, শাসক দল তাই আগাগোড়া ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করে আসছে। অন্যরাও যাতে এই নিয়ে বিশেষ মুখ না খোলে, সে জন্য সর্বত্র লোক হাজির রেখে চাপের কৌশলও নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ অবশ্য দাবি করেছে, তদন্ত ঠিক পথেই এগোচ্ছে। রেল পুলিশ সুপার দেবাশিস সরকার ও ডিআইজি আরএন মুখোপাধ্যায় তদন্তের অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে গিয়েছেন। রেল পুলিশের এক কর্তার দাবি, “কোনও দলের পক্ষ থেকে কোনও চাপ দেওয়া হচ্ছে না।”
এই ঘটনা যদি আত্মহত্যাই হয়, তা হলে ছাত্রীর শরীরে পোশাক থাকবে না কেন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। এ দিন বেলা ৯টা নাগাদ তাঁদের একটি দল রেল লাইনে তদন্তে যান। তাঁরা আরও বেশ কিছু প্রশ্নের জবাবও পাননি। যেমন, ট্রেনের ধাক্কায় শুধুমাত্র হাত কাটা যাবে কেন? ট্রেনের ধাক্কা খেয়ে দেহটি উপুড় হয়ে পড়ল কী করে? পুলিশের প্রাথমিক তদন্তেও ওই ব্যাপারে কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি বলে ফরেন্সিক বিভাগ সূত্রের দাবি। তবে আত্মহত্যার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। সে ক্ষেত্রে তাঁরা খতিয়ে দেখছেন, আত্মহত্যায় প্ররোচনার ছিল কি না।
পুলিশি তদন্তে বেশ কিছু ফাঁক নজরে এসেছে ইতিমধ্যেই। বিভিন্ন সূত্রে খবর, ঘটনার রাতেই বাড়ির দরজার সামনে থেকে ছাত্রীর একপাটি চটি পান পরিবারের সদস্যরা। সে চটি এখনও পুলিশ সংগ্রহ করেনি। কোথায় চটি পড়েছিল, তা-ও পুলিশ দেখতে যাননি। ঘটনার রাতে যখন বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে সালিশি সভায় ছাত্রীর বাবা-মাকে আটকে রাখা হয়েছিল, সে সময় ছাত্রী দৌড়ে বাড়িতে পালিয়ে আসেন বলে পরিবারের দাবি। সে রাতে বাড়ির সামনে মোটরবাইকের শব্দও পেয়েছিলেন পড়শিরা। বাইকে চাপিয়ে ছাত্রীকে অপহরণ করা হয় কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা। উদ্ধার হওয়া দেহে কাদার চিহ্ন ছিল না বলে জানা গিয়েছে। অথচ ছাত্রীর বাড়ি এবং রেল লাইনের মাঝে ধান খেত রয়েছে। বর্ষায় জল ভরা খেতের আলের উপর দিয়ে গেলেও পায়ের অনেকটা জুড়ে কাদা লাগার কথা। তাই মোটরবাইকে ছাত্রীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
রেল পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এফআইআর-এ এলাকার সব্জি বিক্রেতা তহিদুল ইসলামের নাম দেওয়া থাকলেও, তাঁর পড়শি মাংস বিক্রেতা তহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর নমিতা রায়ের স্বামী চন্দ্রকান্তবাবুর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও বলেন, “ওই সালিশিতে মাংস বিক্রেতা তহিদুলকে তো দেখিনি।” ধূপগুড়ির সিপিএম বিধায়ক মমতা রায়ের আশঙ্কা, তৃণমূল নেতাদের চাপে পুলিশ নিরীহদের ধরে হেনস্থা করছে। রেল পুলিশের অবশ্য দাবি, ওই এফআইআরে ক’জনের নাম ছাড়াও উল্লেখ রয়েছে, ঘটনাস্থলে আরও ৫০ জন হাজির ছিলেন। সেই সূত্রেই তহিদুলকে ধরা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment