মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সমীপেষু
আপনি ক্ষমা না করলে আমার সর্বনাশ
‘আমি আর কিছু চাই না। শুধু আপনার আশীর্বাদ। আমি বোকা বলে কেউ আমায় কাজ দেয় না। আপনার আশীর্বাদ পেলে আগামী চার পুরুষ আমাদের অন্তত খাওয়ার চিন্তা থাকবে না।’ সুপর্ণ পাঠক
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪,
(সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
(সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সমীপেষু
নবান্ন
হাওড়া
শ্রীচরণেষু দিদি,
প্রথমেই আমার ও আমার বৃদ্ধা মা সহ আমার পরিবারের প্রণাম নেবেন।
এই চিঠি আমার আশি বছরের মায়ের নির্দেশেই। এই রাজ্যের অনেকের মতোই উনিও বিশ্বাস করেন, মহাশক্তির অংশে আপনার জন্ম। আপনার আশীর্বাদের হাত যার মাথায়, তাকে যমেও ছুঁতে ভয় পায়। তাই দূর গাঁয়ের মানুষ হয়েও ওঁর ইচ্ছা, কালীঘাটে মাকে প্রণাম করে ফেরার পথে এক বার আপনার পদধূলি মাথায় ছোঁয়াবেন। তাতেই নাকি ওঁর সব পাপ ক্ষালন হয়ে যাবে।
আপনার যে শক্তির অংশে জন্ম, তা উনি অনেক দিন থেকেই বলেন। তাঁর মতে, সাধারণ মানুষ তাদের অজ্ঞতার জন্যই দীর্ঘকাল আপনার শক্তিকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। দৈবের বিধিই এমন যে, অজ্ঞ সমাজকে আগুনের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধি করতে হয়, চিত্ত শুদ্ধ হলেই তবেই মানুষ শক্তিরূপিণীকে চিনতে পারে। যখন আপনার জয়ের খবর এল, মা তখন হাত জোড় করে বলেছিলেন, ‘এ বার দেশে ধর্ম ফিরবে।’
আমি দিদি অতশত বুঝি না। খালি এটা বুঝি, আপনি ক্ষমা না করলে আমার সর্বনাশ অবধারিত। দাদা বলেন, আমার বুদ্ধিতে নাকি গোবরের আধিক্য। তা সে যতই গোবর হোক, নিজের হিতাহিত বোঝার ধকটুকু আছে। তার উপরে মায়ের বকুনি। আগের চিঠিটার কথা উনি জানতেন না। সর্বনাশটা হয়েছিল গাঁয়ের এক দাদাকে চিঠিটা দেওয়ায়। আপনার কাছে পৌঁছে দিতে বলেছিলাম, কিন্তু তিনি রগড় করতে তাঁর কলকাতার এক সাংবাদিক বন্ধুর হাতে সে চিঠি তুলে দেন। আর সে আরও রগড় করে খবরের কাগজে ছাপিয়ে দেয়।
সেই চিঠিতে তো আমি যা লিখেছিলাম তার নাকি মানে দাঁড়ায় যে, আপনি স্বৈরাচারী। এই শব্দটার মানে আমি ঠিক জানতাম না। আসলে হয়েছিল কী, সেই যে বাচ্চার ডাক্তার, যে নাকি কলকাতার সরকারি হাসপাতালে সদ্যোজাতদের বাঁচানোর জন্য কী সব ব্যবস্থা করেছিল কম টাকায়। কিন্ত লোকটা ঠেঁটা ছিল। তাকে কেমন শাস্তি দিলেন। সেটা দেখেই আমি ওই চিঠি লিখি। আমি লিখেছিলাম, ক্ষমতায় এসেই আপনি যে এই হাতে মাথা কাটছেন, তা ঠিক হচ্ছে না। তখন ছাই বুঝিনি যে আসলে আপনি কী করছেন। কিন্তু মা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, লোকশিক্ষের জন্য শক্তিপ্রদর্শন করতে হয়, আপনি ওই ডাক্তারটাকে শাস্তি দিয়ে লোককে শিক্ষে দিয়েছিলেন। সে নাকি এখন দিল্লি পালিয়েছে। তবে? যদি সেই ধকই থাকত তা হলে কি পালাত? তখন আমি এ-সব বুঝিনি তো, কী করব? বোকা মানুষ। তাই তো লোকে আমায় বেকুব বলে।
এটাই মোদ্দা কথা। শক্তির অংশ কি না তা তোমার বোঝার দরকার নেই। সে কঠিন কথা। সোজা কথা সোজা ভাবে বোঝ না বাপু। রাজ্যে থাকবে আর রাজাকে থুড়ি রানিকে মানবে না? তার পরেও যদি আইন তোমার বিরুদ্ধে যায়, রাজপেয়াদার হুড়কো খাও, তখন লাফালাফি?
কিন্তু দেখুন, আপনার অনুগত যে, তাকে তো কোথাও বদলি হতে হয় না! এই যে অনুব্রত। সবাই তো সেই কবে থেকে ওর ন্যাজ মুচড়োতে চাইছে। চাইছে কি না? কিন্তু আপনার আশীর্বাদের হাত ওর মাথায় আছে, সুতরাং কেউ কুটোটি নাড়তে পারছে না। কিংবা ধরুন, উত্তরবঙ্গে কী একটা মশা কামড়ানো রোগে সব মারা পড়ছিল। আপনি বললেন, ‘ধুস!’ অমনি সব মশা ফুস হয়ে গেল, সব মরা অমনি বন্ধ। গেল কি না? তবে? হ্যাঁ, মা সব বুঝিয়ে দিয়েছেন আমায়। মা যা বোঝেন, তা এই শহুরে বাবুরা এত বুদ্ধি নিয়ে কেন যে বোঝে না!
বলে কিনা, ‘রাজধর্ম পালন কর।’ বলিহারি যাই বাবা! আরে, রাজধর্ম কি রাজদণ্ড ছাড়া পালন করা যায়? সবাই মিলে ভোট করে রাজ্যপাট দিয়েছ, আর এখন বলছ শাসন কোরো না? এই যে চ্যাংড়ার দল। বলে কিনা ভিসির চামড়া গুটিয়ে দেবে! বোঝো আবদার! তো, শিশুর দল আজগুবি আবদার করবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু রানি, তিনি তো নাগরিকের অভিভাবক, মাতৃতুল্য। যখন শিশুরা অন্যায় আবদার করে, তখন মা তাদের শাসন করেন না? এরা এটাই বুঝতে পারছে না যে আপনি শুধু মায়ের ভূমিকায় বাচ্চাদের শাসন করেছেন মাত্র। আবার বলে, গণতন্ত্র নেই। আরে, মা তার সম্তানকে শাসন করছে, তাতে আবার তন্ত্রটন্ত্র টানা কেন বাবা?
বাবুদের আবার ভিসির ভয় পাওয়া নিয়েও আপত্তি। চামড়া গুটিয়ে নেওয়ার স্লোগান নাকি বহু পুরনো। তা হবে। কিন্তু উনিও চাড্ডি বই পড়েই ভিসি হয়েছেন, না কি! এক বার ভাবুন তো, রামের ডাকে এই বাঁদরকুল কী লঙ্কাকাণ্ডই না করেছিল? তা উনি কোন ভরসাতেই বা রামভক্তদের মন পড়তে যাবেন? কী করেই বা জানবেন, দেবীপক্ষের প্রাক্কালে এরা সব রক্তবীজ নয়? এমতাবস্থায় সবাই যা করে, উনিও তাই করেছেন। দিদি, উনি আপনাকে স্মরণ করেছেন। ভক্তের আহ্বানে আপনাকে তো শক্তিরূপেই প্রকট হতে হবে। তা-ই হয়েছেন। বাবুরা হতভাগ্য, পাপীতাপী, আপনার দৈব অংশকেই আসুরিক বলে মনে করে লম্ফঝম্প করছেন।
দিদি, আপনার সময় কম। সবাই বলে, আপনার এত কাজ যে এক গোছা সচিব নিয়েও তা সামলানো মানুষের পক্ষে অসম্ভব, বিশেষ করে এই অর্বাচীনের রাজ্যে। বহুভুজা না হলে ওই রকম চকচকে পরিষ্কার কাজের টেবিল হতে পারে কি? তারই মাঝে আমার এই চিঠি। আপনি খামের উপর চোখ বোলালেই বুঝে যাবেন আমার মনের কথা। তবুও এতটা লেখা, কারণ যদি কোনও সচিব— সে তো আপনার মতো অন্তর্যামী নয়— সাদা কাগজ দেখে দুষ্টু লোকের চ্যাংড়ামি ভেব ফেলে দেয়! তাই এতটা লিখে আমাকে প্রমাণ করতে হল যে কতটা অনুতাপ আমার হয়েছে।
আমি আর কিছু চাই না। শুধু আপনার আশীর্বাদ। আমি বোকা বলে কেউ আমায় কাজ দেয় না। আপনার আশীর্বাদ পেলে আগামী চার পুরুষ অন্তত খাওয়ার চিন্তা থাকবে না।
ইতি
আপনার একান্ত অনুব্রততুল্য অনুগত আশীর্বাদপ্রার্থী
No comments:
Post a Comment