Friday, August 22, 2014

Who accompanied Mamta to Singapore - Coal Mafia

দূর্নীতির আরেক নাম মমতা


বিতর্কিত ব্যবসায়ী কি মমতার সঙ্গী, উঠছে প্রশ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদন (সৌজন্যে - আনন্দবাজার পত্রিকা) 

২২ অগস্ট, ২০১৪, ০২:৪৬:০০

কয়লার কালিঝুলি-মাখা জগৎ থেকে সিঙ্গাপুরের ঝকঝকে দুনিয়া কতটা দূর! সিঙ্গাপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গী শিল্পপতিদের মধ্যে আসানসোল-দুর্গাপুর এলাকার বিতর্কিত কয়লা ব্যবসায়ী বলে পরিচিত এক ব্যক্তির উপস্থিতিই উস্কে দিয়েছে এই জল্পনা।
রাজ্যের জন্য লগ্নি আনতে বিদেশ সফরে গিয়ে প্রতিনিধিদলে কাদের রাখা হয়েছে, সেই সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য প্রকাশের দাবি তুলেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী।
সিঙ্গাপুরে মুখ্যমন্ত্রী যত জন প্রতিনিধি নিয়ে গিয়েছেন, সাধারণত প্রধানমন্ত্রীরাও অত বড় দল নিয়ে যান না বলে প্রথম থেকেই সরব ছিল বিরোধীরা। পক্ষান্তরে রাজ্য সরকারের বক্তব্য ছিল, প্রতিনিধিদলে বেশির ভাগই শিল্পপতি। এই চাপান-উতোরের মাঝেই সিঙ্গাপুরে গিয়ে পাখিরালয় দেখতে যাওয়ার পথে মুখ্যমন্ত্রীর বাস-সফরের একটি ছবি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত ওই ছবি হাতে নিয়েই বিমানবাবু বৃহস্পতিবার প্রশ্ন তুলেছেন, “এই ব্যক্তি কোন শিল্পপতি? কে নিয়ে গিয়েছে এঁকে? সম্পূর্ণ তথ্য জানাক সরকার।”
‘সরকারি বিষয়’ বলে প্রশ্নটি নিয়ে কিছু বলতে চাননি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। আর মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “সিঙ্গাপুরে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমার কাছে নেই। ওখানে কারা গিয়েছেন তা নিয়েও আমি সম্পূর্ণ অবগত নই।”
কিন্তু বিমানবাবুর অভিযোগ, “স্থানীয় লোকজনের কাছে আমরা জেনেছি, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছবিতে এক জনকে দেখা যাচ্ছে, যিনি নাকি কোল মাফিয়া বলে পরিচিত। তাঁর নাম কৃষ্ণমুরারি কয়াল ওরফে বিল্লু।” অধুনা কলকাতার বাসিন্দা, আদতে রানিগঞ্জের লোক এই কয়ালের বিরুদ্ধে ‘অনেক মামলা ছিল’ বলেও দাবি করেছেন বিমানবাবু। বাম জমানায় আসানসোল শিল্পাঞ্চল এলাকার কয়লা-মাফিয়া বলে পরিচিত কালে সিংহ এক বার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে ত্রাণ তহবিলের চেক তুলে দেওয়ায় প্রভূত বিতর্ক হয়েছিল। বুদ্ধবাবু শেষ পর্যন্ত ওই চেক ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিমানবাবুরা এখন যাঁর কথা বলছেন, তাঁর নামে পুলিশের খাতায় তেমন কোনও অভিযোগ আছে কি? বিমানবাবুর জবাব, “স্থানীয় সূত্রে জেনেছি, একাধিক মামলা ছিল। সে সব কেস আছে, না উঠে গিয়েছে, আমার জানা নেই। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন!” যাঁকে ঘিরে এই চাপান-উতোর, সেই কয়ালের সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর ফোন বন্ধ ছিল।
তবে মধ্য চল্লিশের কয়ালকে রানিগঞ্জ এখনও বিল্লু নামেই চেনে। একদা প্যাকেট করে নুন বিক্রেতা বিল্লুর চমকপ্রদ উত্থান অনেকেরই বিস্ময়কর ঠেকে। বছর ছয়েক আগে কয়লা মাফিয়া রাজু ঝা-এর সঙ্গী হিসেবে পরিচিতি তৈরি হয় তাঁর। তখনকার শাসক দলের নেতা সুশান্ত ঘোষের সঙ্গেও বিল্লুর ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে স্থানীয় সূত্রের দাবি। বিমানবাবুকে খোঁচা দিয়ে এ দিন তাই পার্থবাবুর মন্তব্য, “কয়লা আর ময়লা কারা, তা বিমানবাবুর থেকে ভাল কেউ জানেন না।”
রাজ্যে পালাবদলের পরে রাজুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অথচ নিজের ব্যবসা অটুট রেখে কয়াল কিন্তু তাঁর সাম্রাজ্য বাড়িয়ে চলেছেন বলেই স্থানীয় মানুষের দাবি। এখন বর্ধমান, বীরভূম ও পুরুলিয়ার কিছু এলাকায় কয়লার কারবারে কয়ালের দাপটের কথা মানছেন পুলিশের একাংশও। ওই তল্লাটের এক পুলিশকর্তার দাবি, “রাজুর সঙ্গী হিসেবেই এ সব কারবারে জড়িয়েছিলেন কয়াল। রাজু গ্রেফতার হওয়ার পরেও বকলমে তাঁর নামে এ সব কাজ চালাতেন।”
পুলিশ সূত্রের খবর, রাজু ধরা পড়ার পরে এক সময় কয়ালের প্যাডেও কয়লা আমদানি হয়েছে। শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই তাঁর রক্ষাকবচ। শাসক দলের একাধিক মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের গুরুত্বর্পূণ এক আধিকারিকের সঙ্গে কয়াল ক্রমাগত যোগাযোগ বাড়িয়ে গিয়েছেন। কয়লা মাফিয়াদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেও শাসক দলের সংস্রব তাঁকে নানা ‘অ্যাডভান্টেজ’ দিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। আসানসোলের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরীর বক্তব্য, “কী ঘটছে, তৃণমূল কী করছে, খনি এলাকার মানুষ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন! এর বেশি আর কিছু বলার দরকার নেই!”
সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের আসানসোল লোকাল কমিটির সম্পাদক সুরেন্দ্র সিংহের অভিযোগ, “রাজু ঝায়ের আড়ালে কৃষ্ণ কয়াল কয়লা-সহ নানা অবৈধ কারবারে যুক্ত। শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্যই তিনি ছাড় পেয়েছেন।” কর্পোরেট সংক্রান্ত সরকারি নথি বলছে, আধুনিক ভেঞ্চার্স, আধুনিক কন্ট্র্যাক্টর্স ও গণপতি ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল নামে তিনটি সংস্থায় কয়ালের সঙ্গে অন্যতম ডিরেক্টর রাজুর স্ত্রী রঞ্জুদেবী। কংগ্রেসের বর্ধমান জেলা (শিল্পাঞ্চল) সম্পাদক চণ্ডীচরণ চট্টোপাধ্যায় কয়াল ওরফে বিল্লুর বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন।
তৃণমূলের জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতি ভি শিবদাসনের অবশ্য পাল্টা দাবি, সব অভিযোগ ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। কয়ালের দীর্ঘদিনের সুহৃদ তথা সফ্টঅয়্যারের একটি সংস্থায় (ইস্ট ওয়েস্ট মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রি) তাঁর ‘পার্টনার’ পঙ্কজ খেতানেরও দাবি, কয়াল অবৈধ কয়লা ব্যবসায় যুক্ত নন। আসানসোল ছেড়ে গত বছর দশেক ধরে তিনি প্রধানত কলকাতার কাঁকুড়গাছির বাসিন্দা। নিমতা, দুর্গাপুর বা অন্যত্র একাধিক আবাসন ও সড়ক প্রকল্প, বাণিজ্যিক নির্মাণে যুক্ত। যুক্ত শিল্পসংক্রান্ত কিছু উপদেষ্টা সংস্থার সঙ্গেও। কে জে রিয়েলইনফ্রা, ভিটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশনের মতো কয়েকটি সংস্থার তিনি কর্ণধার। রয়েছে মশলার কারবার। কয়ালের ঘনিষ্ঠ এক সূত্রের খবর, ওড়িশার বারবিলে লৌহ আকরিক ক্রাশিং ইউনিটও রয়েছে কয়ালের।

এখন প্রশ্ন হল, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে কয়াল ঢুকলেন কী ভাবে? রাজ্য বা কলকাতার উচ্চকোটির কাছে নিজের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হোটেল, আবাসন প্রকল্পের পাশাপাশি অধুনা টালিগঞ্জের গ্ল্যামার দুনিয়ায় পা রেখেছেন তিনি। আগে রিপ্রোডাকশন এন্টারটেনমেন্ট সংস্থার হয়ে বেশ কয়েকটি ছবির বিপণনে জড়িত ছিলেন কয়াল। এখন ব্ল্যাক পেপার এন্টারটেনমেন্ট সংস্থার ব্যানারে একসঙ্গে খান সাতেক ছবির প্রযোজনায় যুক্ত। টালিগঞ্জে কয়ালের এই প্রতিপত্তিই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে প্রবেশের ‘পাসওয়ার্ড’ দিয়েছে বলে রাজনীতি ও বিনোদন জগতের কারও কারও দাবি।
বস্তুত, শুধু সিঙ্গাপুর নয়, মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন সফর বা কর্মসূচিতে গত কয়েক বছরে বার কয়েক দেখা গিয়েছে কয়ালকে। মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক উত্তরবঙ্গ সফরেও সঙ্গী ছিলেন তিনি। সেই ধারা মেনেই চলতি সিঙ্গাপুর সফরে বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছাকাছি ছিলেন তিনি। পঙ্কজ খেতান যদিও দাবি করছেন, কয়াল মোটেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী শিল্প-প্রতিনিধি দলের এক জন নন। খেতানের কথায়, “ঘটনাচক্রে, নিজের ব্যবসার কাজে কয়াল এখন সিঙ্গাপুরে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওঁর দেখাও হয়েছে। তার মানেই এটা প্রমাণ হয় না উনি মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী।” যদিও বিমানবাবুর প্রশ্ন, “উনি তো পাখিরালয় দেখার সময় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাসে ছিলেন! সংবাদপত্রে ছবি দেখা যাচ্ছে।”
এ দিন দুপুরে মণি স্কোয়ারের সাত তলায় কয়ালের একটি সংস্থা আধুনিক ভেঞ্চার্স-এর অফিসে গিয়েও দেখা গেল, সংস্থার কণর্ধার সিঙ্গাপুরে মুখ্যমন্ত্রীর ‘টিম বেঙ্গল’-এর এক জন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে সেখানকার কর্মচারীরা রীতিমতো গর্বিত। ওই সংস্থাটি রানিগঞ্জ-দুর্গাপুর হাইওয়েতে ‘সরোবর গোষ্ঠী’র সঙ্গে একটি হোটেল তৈরি করছে। দুর্গাপুজোর পুরস্কারের সঙ্গেও কয়াল নিজেকে যুক্ত করেছেন। ধূমপান-বিরোধী বার্তা নিয়ে ‘স্মোক ফ্রি শারদশ্রী’ বলে একটি পুজো-সম্মানের পৃষ্ঠপোষক তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কয়াল যখন সিঙ্গাপুরে, তখন কলকাতায় তাঁর প্রযোজনায় ‘হঠাৎ হলিডে’ নামে ছবির শ্যুটিং চলছে। লেকল্যান্ড কান্ট্রিক্লাবে শ্যুটিংয়ের ফাঁকে অভিনেত্রী কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওঁর (কয়াল) সঙ্গে এক বার মুম্বইয়ে মধ্যাহ্নভোজের একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। চেকে ওঁরই সই দেখেছি। কিন্তু এর বেশি তো জানি না!”

No comments:

Post a Comment