Monday, August 25, 2014

মমতার ইন্ধনে তৃণমূল নেতারা ধর্ষণ সন্ত্রাসের হুমকি দিচ্ছে

নদিয়ার চৌমুহার পরে এ বার ঘটনাস্থল মেদিনীপুর। চৌমুহায় অভিযুক্ত ছিলেন তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল। মেদিনীপুরে অভিযুক্ত শহরের উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ দাস।

আবার ধর্ষণের হুমকি, অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেদিনীপুর, ২৫ অগস্ট, ২০১৪, ০৩:৩৬:৩৪


অভিযুক্ত উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ দাস।

ফের ‘রেপ’ করানোর হুমকি জনপ্রতিনিধির মুখে। শুধু রেপ নয়, মায়ের সামনেই মেয়েকে খুন করার হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠল ওই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে।

নদিয়ার চৌমুহার পরে এ বার ঘটনাস্থল মেদিনীপুর। চৌমুহায় অভিযুক্ত ছিলেন তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল। মেদিনীপুরে অভিযুক্ত শহরের উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ দাস।

শহরের শরৎপল্লির বাসিন্দা এক বিধবার অভিযোগ, তাঁর একটি জমি বিক্রি হয়েছিল ১৫ লক্ষ টাকায়। কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়েছে অর্ধেক। বাকি টাকা চেয়েও না পাওয়ায় তিনি ও তাঁর মেয়ে গত ২১ অগস্ট জিতেন্দ্রনাথবাবুর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। জিতেন্দ্রনাথবাবুই ওই জমি বিক্রিতে মধ্যস্থতা করেছিলেন বলে মহিলার দাবি। কিন্তু অভিযোগ, উপ-পুরপ্রধান টাকা ফেরানোর বন্দোবস্ত তো করেনইনি। উল্টে ওই মহিলার তরুণী মেয়েকে ধর্ষণ করিয়ে খুন করার হুমকি দেন!

জিতেন্দ্রনাথবাবু অবশ্য সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ওই জমি কেনাবেচার ব্যাপারে তিনি জড়িত ছিলেন না। অভিযোগকারিণী মা-মেয়ের সঙ্গে তাঁর ২১ তারিখ দেখাই হয়নি। হুমকি দেওয়া তো দূরস্থান!

২১ তারিখই কিন্তু মা-মেয়ে লিখিত অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন কোতোয়ালি থানায়। বিধবার অভিযোগ, পুলিশ তাঁদের ফিরিয়ে দেয়। পর দিন, শুক্রবার জেলার পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষের কাছে গিয়ে বছর পঞ্চাশের ওই মহিলা লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। সেই অভিযোগপত্রে জিতেনবাবুর পাশাপাশি নাম রয়েছে তাঁর ভাই সুকুমার দাস, পড়শি সলিল চৌধুরী এবং ওই জমিটির ক্রেতা সহদেব চৌরা-র। তবে অভিযোগপত্রে শুধু টাকা না পাওয়া এবং শাসানির কথাই লেখা হয়েছে। জিতেনবাবু যে তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ ও খুন করানোর হুমকিও দিয়েছেন, সেই অভিযোগের কথা কিন্তু লেখা নেই। কেন? মহিলার মেয়ের দাবি, “মা নিরক্ষর। আমিও ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি। অভিযোগ লেখানোর জন্য কার্তিকচন্দ্র দাস নামে এক মুহুরির সাহায্য নিয়েছিলাম। আমরা সমস্ত বললেও তিনিই ধর্ষণ ও খুনের হুমকির কথা উল্লেখ করতে ভুল করেছেন।” কার্তিকবাবুর সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।

তবে মা-মেয়ের আইনজীবী শুভজিৎ রায়ের বক্তব্য, তাড়াহুড়ো করে লিখতে গিয়ে মুহুরি কিছু কথা বাদ দিয়েছেন। এখন ওঁরা নতুন করে সরাসরি আদালতে অভিযোগ জানাবেন বলে ঠিক করেছেন। সেখানে ধর্ষণ-খুনের হুমকির কথা লেখা থাকবে।

রবিবার সকাল থেকে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে খবরটি সম্প্রচারিত হওয়ার পরে অবশ্য নড়েচড়ে বসেছে পুলিশও। এ দিনই বিকেলে ওই মহিলার বাড়িতে গিয়ে কোতোয়ালি থানার আইসি সুশান্ত রাজবংশী এবং অফিসার মৃণাল শিকদার (২১ তারিখ ইনিই ছিলেন ডিউটি অফিসার) অভিযোগপত্রের একটি প্রতিলিপি নিয়ে যান। পুলিশ সুপার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, “হুমকির অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

শাসক দল কী বলছে? তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কী ঘটেছে ভাল করে না জেনে মন্তব্য করা উচিত হবে না। ওই জেলায় আমাদের দলের নেতা দীনেন রায়, প্রদ্যোৎ ঘোষকে বলা হয়েছে বিষয়টি জেনে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাতে।  তার ভিত্তিতেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেনবাবু জানিয়েছেন, অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দলের শহর কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঘটনাটি কী ঘটেছিল? শরৎপল্লিতে তিন কাঠার কিছু বেশি জমির উপর একটি ঝুপড়িতে থাকেন ওই মা-মেয়ে। সম্প্রতি জমি বিক্রি করে অন্যত্র যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। পাড়ারই বাসিন্দা সলিল চৌধুরীর মাধ্যমে গড়বেতার মঙ্গলবাঁধ গ্রামের বাসিন্দা সহদেব চৌরাকে জমি বিক্রির বন্দোবস্ত হয়। সলিলবাবুর সঙ্গে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথবাবুও জমি বিক্রির মধ্যস্থতায় ছিলেন বলে ওই মহিলার দাবি। তিনি জানান, জমির দাম ঠিক হয়েছিল ১৫ লক্ষ টাকা। বায়না বাবদ দেওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা। ১৮ অগস্ট জমি রেজিস্ট্রির দিন মা ও মেয়ের নামে ৩ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা দু’টি চেক এবং নগদ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকি সাড়ে ৭ লক্ষ টাকা পরে দেওয়া হবে বলে জানান সলিলবাবু। ওই মহিলা বলেন, “বাকি টাকা পেলেই জমি ছেড়ে দেব বলেছিলাম। কিন্তু বকেয়া টাকার জন্য সলিলবাবুকে বলতে গেলে তিনি জানান, পুরো টাকাই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। জমি-বাড়ি ছাড়ার জন্য আমাদের চাপ দেওয়া শুরু হয়।”

রবিবার ওই মহিলার বছর ছাব্বিশের মেয়ে বলেন, “গত ২১ অগস্ট (বৃহস্পতিবার) আমি আর মা জিতেনবাবুর বাড়ির অফিসে যাই। উনি আমাদের ঢুকতে দেননি। বাইরে এসে বলেন, ‘সব টাকা তো পেয়ে গিয়েছেন। আর কী চাই?’ বকেয়া টাকার কথা বলায় উনি খেপে গিয়ে মাকে বলেন, এই যে মেয়েকে দেখছেন, বাড়াবাড়ি করলে মেয়ের গায়ের জামাকাপড়টুকুও থাকবে না! ওকে রেপ করে মার্ডার করিয়ে দেব!” মেয়েটির দাবি, জিতেনবাবুর ভাই সুকুমার দাসও তাঁকে আর তাঁর মাকে মেরে পুঁতে ফেলবেন বলে শাসানি দেন।

এখানেই শেষ নয়। শুক্রবার পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ জানিয়ে আসার পরে শনিবার জিতেনবাবুর লোকজন বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছেন বলেও অভিযোগ মা-মেয়ের। অভিযোগ, যে সাড়ে ৭ লক্ষ টাকা তাঁরা পেয়েছেন, তার অর্ধেকও ‘পার্টি ফান্ডে’ দিতে হবে বলে দাবি করেছেন উপ-পুরপ্রধান।

যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে জিতেনবাবুর দাবি, “জমি কেনাবেচার মধ্যে আমি ছিলামই না। ওই জমি যে বিক্রি হয়েছে, সে কথা জানতে পারি জমি রেজিস্ট্রির আগে ওঁরা গাছ কাটার জন্য ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট (এনওসি) নিতে আসার সময়ে।” মেয়েটি কিন্তু দাবি করছেন, গাছ কাটার জন্য এনওসি তাঁরা চেয়েছিলেন বন দফতরের কাছে। পেয়েও যান। এনওসি-র জন্য জিতেনবাবুর দ্বারস্থ তাঁদের হতে হয়নি।

বকেয়া নিয়ে জমির ক্রেতা সহদেববাবুর কী বক্তব্য? তাঁর কথায়, “আমি সলিলবাবুকে পুরো ১৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম। পরে ওই মহিলাদের কাছ থেকে জানতে পারি, তাঁরা সাড়ে ৭ লক্ষ টাকা পেয়েছেন।” এলাকায় জমি-বাড়ির দালাল হিসেবে পরিচিত সলিলবাবুকে এ দিন বাড়িতে পাওয়া যায়নি। এক মহিলা নিজেকে তাঁর বড় শ্যালিকা পরিচয় দিয়ে বলেন, “উনি এখন এখানে থাকেন না। কোথায় থাকেন, জানি না!” বাড়ির বাইরে নেমপ্লেটে অবশ্য সলিলবাবুর নামই লেখা রয়েছে।

শনিবারের হামলার কথা পুলিশকে জানানো হয়েছে কি? ওই তরুণী বলেন, “এ দিন যখন পুলিশ অফিসাররা এসেছিলেন, তখন ওঁরা ঘটনাটির কথা থানায় জানাতে বলে গিয়েছেন। কিন্তু থানা তো আগের দিন ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাই এ বার সরাসরি আদালতে অভিযোগ জানাব।”

জমি-বাড়ি কেনাবেচার কারবারে শাসক দলের নেতা-কর্মীরা যে বারেবারে জড়িয়ে পড়ছেন, মেদিনীপুরের ঘটনা তারই আরও একটি প্রমাণ বলে দাবি করছেন বিরোধীরা। সেই সঙ্গে তাঁরা সরব হয়েছেন জনপ্রতিনিধির মুখে ধর্ষণ-খুনের হুমকি প্রসঙ্গেও। তাপস পালের ঘটনার পরে গত সপ্তাহে পূর্ব মেদিনীপুরের সুনিয়ায় সিপিএমের এক ঘরছাড়া নেতার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতির এক কর্মাধ্যক্ষ-সহ দলের ১২ জন কমী-সমর্থকের বিরুদ্ধে। এ বার হুমকির দেওয়ার অভিযোগের আঙুল পুর উপপ্রধানের দিকে। সিপিএমের মেদিনীপুর শহর জোনাল কমিটির সম্পাদক কীর্তি দে বক্সীর কথায়, “এটাই তৃণমূলের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে!” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “তাপস পাল সংস্কৃতিই রাজ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে তৃণমূল! এই ধরনের অপরাধমূলক মন্তব্যে প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ না করলে নৈরাজ্য ঠেকানো যাবে না।”


No comments:

Post a Comment