সম্পাদকীয় ১
স্বজন পোষণ
২৮ অগস্ট, ২০১৪, ০০:০০:০০
(সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
কলিকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় জানাইয়াছেন, ‘বিনোদিনী রেপার্টরি’ বাবদ যে টাকা খরচ হইবে, তাহা তিনি নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি হইতে দিতেছেন না। তাহা পুরসভারই টাকা। তাঁহার নিজস্ব বা পৈত্রিক সম্পত্তির ব্যবহার লইয়া কলিকাতাবাসীর আগ্রহ নাই। কিন্তু, পুরসভার টাকায়, অর্থাত্ নগরবাসীর করের টাকায় কী হইতেছে, তাহা জানিবার অধিকার মানুষের বিলক্ষণ আছে। কলিকাতা নামক শহরটি সংস্কৃতির পীঠস্থান কি না, সে প্রশ্ন অবান্তর। শহরে নাট্যচর্চার পৃষ্ঠপোষক হওয়া পুরসভার কাজ নহে। রাস্তাঘাট সারাই, জল সরবরাহ বা জঞ্জাল সাফাইয়ের ন্যায় কাজগুলি নিষ্ঠার সহিত করিয়া যাওয়াই পুরসভার দায়িত্ব। পুরসভা নামক প্রতিষ্ঠানগুলিকে টিকাইয়া রাখিবার আদৌ যদি কোনও যৌক্তিকতা থাকে, তবে তাহা এই দায়িত্বটুকুই। সংস্কৃতিমনস্ক মেয়রের এই কাজের পৌনঃপুনিকতা ভাল না-ই লাগিতে পারে। পুরসভার দায়িত্ব ত্যাগ করিয়া তিনি নিজস্ব বা পৈত্রিক সম্পত্তিতে বিলক্ষণ সংস্কৃতিচর্চা করিতে পারেন। তবে, অনুমান করা সম্ভব, বর্তমান কুনাট্যে মেয়র মহোদয় নিমিত্তমাত্র। বিনোদিনী রেপার্টরি গড়িবার টাকা কলিকাতা পুরসভার তহবিল হইতে ব্যয় করিবার সিদ্ধান্ত হইয়াছে চিত্রনাট্যে এইটুকু গুরুত্বই তাঁহার প্রাপ্য। তবু, মেয়র যখন, এক বার মুখ ফুটিয়া পুরপ্রধান হিসাবে নিজের দায়িত্বের কথাটি উপরমহলকে স্মরণ করাইয়া দিতে পারিতেন। পদমর্যাদা এবং আত্মমর্যাদা, দুইয়েরই মুখ থাকিত।
রেপার্টরির দায়িত্ব যাঁহারা পাইলেন, সেই ব্রাত্য বসু ও অর্পিতা ঘোষ শুধু শাসক দলের ঘনিষ্ঠ নহেন, যথাক্রমে মন্ত্রী ও সাংসদ। ইহা বাম আমলের স্বজনপোষণের ঐতিহ্যের পরবর্তী ধাপ। ব্রাত্যবাবু বলিয়াছেন, তাঁহার রাজনৈতিক পরিচয় যদি নাট্য-পরিচয়ের উপর স্থান পায়, তবে তিনি নাচার। মুশকিল হইল, সিপিএমত্বের পাল্টা তৃণমূলত্ব দেখাইবার তত্ত্বটি যিনি জনসমক্ষে পেশ করিয়াছিলেন, হঠাত্ তাঁহাকে নিরপেক্ষ নাট্যকার হিসাবে মানিয়া লওয়া দর্শকদের পক্ষে সহজ এবং স্বাভাবিক না-ও হইতে পারে। অর্পিতা ঘোষও তাঁহার কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার নজির স্থাপন করিয়াছেন, এমন কথা বলা শক্ত। কাজেই, এই দুই নাট্য-ব্যক্তিত্বকে রেপার্টরির দায়িত্ব দেওয়া হইলে শাসকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক রঙ বাছাইয়ের অভিযোগ উঠিবেই। অবশ্য সেই অভিযোগে কালীঘাটের ইতরবিশেষ হয় বলিয়া আশা হয় না। দলীয় আনুগত্যই এই রাজ্যে একমাত্র যোগ্যতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে। কেহ বরং বলিতে পারেন, তবুও ব্রাত্য-অর্পিতাদের নাটকের সহিত যোগ লইয়া প্রশ্ন নাই এই রাজ্যে তো রুদ্রনীল ঘোষ কারিগরি শিক্ষা সংসদের সভাপতি হইতে পারেন।
ব্রাত্য-অর্পিতার নাট্যজগতের সহিত যোগাযোগ বরং একটি বিপরীত মেরুর প্রশ্ন তৈরি করে। তাঁহারা শুধু নাট্যজগতের মানুষ নহেন, রীতিমত কর্তৃস্থানীয়। তাঁহাদের নিজস্ব দল আছে, নাটক আছে। তাঁহাদের রাজনৈতিক পরিচয় যদি ভুলিয়াও যাওয়া যায়, নাট্যজগতে তাঁহাদের স্বার্থের কথা ভোলা অসম্ভব। এমন মানুষের হাতে রেপার্টরির দায়িত্ব দিলে স্বজনপোষণের সম্ভাবনা থাকিবেই। তর্কের খাতিরে যদি ধরিয়াও লওয়া যায় যে তাঁহারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভাবে, নিজের স্বার্থ ভুলিয়া রেপার্টরির কাজ করিবেন, তবুও সন্দেহের অবকাশটি ঘুচিবে না। এই অবস্থা সৃষ্টির কোনও প্রয়োজন ছিল না। নাট্যজগতে সর্বজনমান্য, কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থহীন কোনও মানুষ কি পশ্চিমবঙ্গে নাই? নাই যে, তাহা নিশ্চিত ভাবে জানা গেল কোন পথে? অনুমান করা চলে, নিরপেক্ষতার মুখোশটুকু বজায় রাখিবার দায়ও প্রশাসন আর বোধ করে না। বাম আমলের ঐতিহ্য যাহাদের ভিত্তি, উদ্দাম দলতন্ত্রই যে তাহাদের ভবিষ্যত্ হইবে, তাহাতে আর সন্দেহ কী?
No comments:
Post a Comment