Wednesday, November 26, 2014

চুরির অধিকার দাবিতে তৃণমূলী বুদ্ধিজীবিদের মিছিল ! বাংলার সম্মান ভূলুন্ঠিত!

এ কোন মিছিল? চক্রান্তের প্রতিবাদ, নাকি চুরির দাবি

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা, ২৭ নভেম্বর, ২০১৪




সপ্তাহ শুরু হয়েছিল এক অভিনব মিছিল দিয়ে। যার স্লোগান ছিল, ‘আমরা সবাই চোর’। সেই মিছিলের মঞ্চ থেকেই আর এক মিছিলের ফতোয়া দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কাল, শুক্রবার শিল্প-সংস্কৃতি জগতের মানুষদের সেই মিছিলে হাঁটার কথা। কার্যত যাকে চুরির অধিকার চাওয়ার মিছিল বলেই কটাক্ষ করছেন অনেকে।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ বলে কথা! অমান্য করার উপায় নেই। ফলে মিছিল ‘ম্যানেজমেন্টে’ কন্যা-কর্তার ভূমিকায় নেমেছেন মূলত তিন জন। সদ্য শিবির বদলানো এক অভিনেতা-পরিচালক। দল পাল্টানো এক কবি। আর বাংলা ছবির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে উঠতে চাওয়া এক প্রযোজক। কর ফাঁকি থেকে শুরু করে অন্যায় সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীর বরাভয় হস্ত সর্বদাই যাঁর মাথার উপরে। অরিন্দম শীল, শ্রীকান্ত মোহতা ও সুবোধ সরকারের হাতে মিছিল ডাকার গুরু দায়িত্ব সঁপে দিয়েছেন মমতা নিজেই।
নেত্রীর ইচ্ছায় কর্ম। অরিন্দম তাই গণ-এসএমএস পাঠাচ্ছেন। তাতে লেখা, “আগামী ২৮ নভেম্বর, শুক্রবার, দুপুর একটায় নন্দনে জমায়েত। সেখান থেকে অ্যাকাডেমি অবধি প্রতীকী মিছিল। কোনও রাজনৈতিক ব্যানারে নয়। বাংলা ও বাংলার সংস্কৃতির উপরে আঘাত ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হতে... পথে এ বার নামো সাথী। প্লিজ এসো।” শ্রীকান্তের সঙ্গে এ দিন কথা বলতে চেয়ে ফোন ও এসএমএস করা হলেও সাড়া মেলেনি। সুবোধবাবু এ দিন দুর্গাপুরে এক আলোচনাসভায় জানিয়েছেন, ২৮ নভেম্বর পথে নামবেন। তিনি বলেন, “বিচারের আগেই বিচারের দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছে সংবাদমাধ্যমের একাংশ। সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলছে।”
কীসের চক্রান্ত? মুখ্যমন্ত্রীর সোমবারের বক্তৃতা থেকে স্পষ্ট, তাঁর রাগ সারদা তদন্তে সিবিআইয়ের ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে। সেই জন্যই সে দিন প্ল্যাকার্ড বলছিল, “আমরা সবাই চোর! আমাদের গ্রেফতার করো!” সেই কর্মসূচিরই পরের ধাপ শুক্রবারের মিছিল। এ বার কি তবে চুরির অধিকারের দাবিতে পথে নামা? নাট্যপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, বিষয়টা হরেদরে সে রকমই তো দাঁড়াচ্ছে প্রায়। তাঁর কথায়, “উদ্ভট ব্যাপার। সিবিআইয়ের ধরপাকড়ের প্রতিবাদে পথে নামা মানে তো চুরির অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাই হল।” সুমন অবশ্য এসএমএস-আমন্ত্রণ পাননি। তবে অন্য এক ‘আমন্ত্রিত’ অভিনেতা বলে ফেললেন, “চুরির অধিকারের দাবিতে মিছিল নন্দনে কেন? আলিপুর জেলখানার সামনে করলেই পারত!”
এই অস্বস্তিটা যে সংস্কৃতি জগতের মধ্যেও নেই, তা নয়। সেটা বুঝেই অরিন্দমরা সরাসরি সারদা-সিবিআই ইত্যাদি না বলে সংস্কৃতির উপরে আঘাতের কথা তুলছেন। কী রকম আঘাত? প্রশ্ন করলে অপর্ণা সেনকে জেরার উদাহরণ টানছেন অরিন্দম। কিন্তু সে তো বেশ কিছু দিন আগের কথা! এখন তার প্রতিবাদ কেন? অপর্ণা নিজে তো কোনও প্রতিবাদের ডাক দেননি? স্পষ্ট কোনও উত্তর নেই আয়োজকদের কাছে।
মমতা-ঘনিষ্ঠ অভিনেতা রুদ্রনীলের কাছেও বিষয়টা পরিষ্কার নয়। তাঁরও খটকা, সংস্কৃতিতে আঘাতটা হঠাৎ কীসে লাগল? রুদ্রর প্রশ্ন: “অরিন্দম পরিবর্তনের আগে টিভি চ্যানেলে বামফ্রন্টের হয়ে সওয়াল করতেন। ওঁর এসএমএসে আমি কেন বিশ্বাস করব? তা-ও যদি প্রসেনজিতের মতো সিনিয়র কেউ ডাকতেন।” প্রসেনজিৎ মিছিল ডাকেননি, মিছিল নিয়ে কিছু বলতেও রাজি নন। গায়ক ইন্দ্রনীল সেন বরং খোলা গলায় হাঁকছেন, “শিল্প, সংস্কৃতি, ক্রীড়া যে-দিকে দেখছি, শুধু বঞ্চনা! চক্রান্ত! যে যেখান থেকে পারেন সকলে আসুন।” চিত্রপরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় গোয়ার ফিল্মোৎসবে রয়েছেন। শুক্রবার শহরে থাকছেন না। কিন্তু মানসিক ভাবে ইন্ডাস্ট্রির পাশে দাঁড়াবেন বলে জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, “ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবাই গেলে আমি পাশে দাঁড়াব। ঠিক-ভুল পরে ভাবব।”
এখানেই প্রশ্ন জাগছে অনেকের মনে। যে প্রতিবাদী স্বরকে বাংলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করা হতো এত কাল, তার সঙ্গে এই নব্য প্রতিবাদীরা খাপ খাচ্ছেন কি? প্রবীণেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে পথে নামা রবীন্দ্রনাথ, খাদ্য আন্দোলনের জমানায় মিছিলে হাঁটা সত্যজিৎ রায় বা হাল আমলে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়েও রাজপথে কবি-সাহিত্যিক-বিশিষ্টদের মহামিছিল যে প্রতিবাদের প্রতিনিধিত্ব করেছে, শুক্রবারের মিছিলের সঙ্গে তার কোনও সম্পকর্র্ নেই। সুভাষ বসু থেকে তরুণী মমতা পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রতিবাদের যে ঘরানা বাংলা দেখেছে, তার সঙ্গেও একে কোনও ভাবেই মেলানো যায় না।
বাম জমানাতেও বিনোদন জগৎ বা সাংস্কৃতিক কর্মীদের একাংশ শাসক দলের তাঁবেদারি করেছেন বলে অভিযোগ। কিন্তু চুরির পক্ষে সওয়াল করে প্রতিবাদ সেই পরম্পরাতেও নয়া সংযোজন। সুমন হেসে বলছেন, “এ এক বীভৎস মজা। বাংলা কেন, জানি না এমন প্রতিবাদ, ভূভারতে কোথায় কবে হয়েছে।”
গায়ে পুরোদস্তুর তৃণমূলের তকমা যাঁদের রয়েছে, তাঁরাও অনেকেই মিছিল নিয়ে মন্তব্যে নারাজ। না-গেলে উপায় নেই, তাই যাবেন বলে ঠিক করেছেন কেউ। কেউ কেউ আবার অন্য কাজ আছে বা শহরে থাকছেন না বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচছেন। মন্ত্রী ব্রাত্য বসু মিছিলে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। তবে বলেন, “২৮ তারিখের পরই এ নিয়ে কথা বলব।” তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী দিল্লিতে সংসদের কাজে ব্যস্ত থাকায় যেতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। মমতা-মনোনীত রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য জুন মালিয়া আবার মিছিলে হাঁটতে গররাজি। তিনি এক আত্মীয়ের বিয়ে আছে বলে যেতে পারবেন না বলছেন। পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর শ্যুটিং চলছে দার্জিলিংয়ে। তাই রাজ-মিমি চক্রবর্তী প্রমুখের থাকার সম্ভাবনা কম। মমতার দলের বিধায়ক চিরঞ্জিতও সম্ভবত থাকবেন না। তাঁর কথায়, “পার্টি যখন করি, তখন বললে যাব। তবে শুক্রবার আমার শ্যুটিং আছে।” অভিনতা-পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ও মিছিলের দিন কলকাতায় থাকা হবে না বলে জানিয়েছেন।
আর মিছিলে যাঁরা থাকবেন, তাঁরাই বা কী করবেন, তা-ও এখনও পরিষ্কার নয়। ইন্দ্রনীল যেমন বলছেন, “হাঁটতে হাঁটতে সলিল চৌধুরীর ‘পথে এ বার নামো সাথী’টা গাইব।” অরিন্দম শীলের দাবি, “মুখ বন্ধ। হাতে পোস্টার। মৌন মিছিল হবে।” মিছিলের ‘রুট’ নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়। গন্তব্য, নন্দন থেকে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস। শুনে আমন্ত্রিত শিল্পীরাই হাসছেন, এ তো রেকর্ড! কলকাতার সংক্ষিপ্ততম মিছিল। সংগঠকরা বোঝাচ্ছেন, ঘুরিয়ে নাক ধরার মতো নন্দনের ফটক ছেড়ে মিছিল যাবে জওহর শিশু মিউজিয়ামের দিকে। সেখান থেকে বাঁ দিকে ঘুরে তারামণ্ডল হয়ে অ্যাকাডেমির সামনে থামবে। তবু মুখ্যমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া দিনক্ষণ অনুযায়ী, মিছিল শুরু করা যায়নি বলে একটা খচখচানি থাকছেই। মমতা চেয়েছিলেন, মিছিল হবে বুধবার। তবু শুক্রবারের আগে কিছু করা গেল না! এমনিতে মমতা ডাকলেই হাজির হন বিনোদন জগতের কেউকেটারা। যে কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে টিভি-ফিল্মের চেনা মুখগুলি মমতাকে ঘিরে থাকেন। তারকা-সমাবেশে উচ্ছ্বসিত মমতা সগর্বে ঘোষণা করেন, “দেব আমাদের, শুভশ্রী-ও!” এই মধুচন্দ্রিমার মেজাজ এ বার যেন খানিকটা বেসুরে বাজছে।
ইন্দ্রনীল-অরিন্দমেরা অবশ্য ভরসা দিচ্ছেন, চিন্তার কিছু নেই! মিছিল জমে যাবে। শুধু প্রশ্ন একটাই, মমতা জমানায় সংস্কৃতি আর গণবিনোদনের ফারাক আগেই গুলিয়ে গিয়েছে। বিরোধীদের কটাক্ষ, প্রতিবাদ আর পদলেহনটাও কি এ বার মিলেমিশে যাবে?


সারদা তদন্তে জালিয়াত তৃণমূলী 'চিত্রকর' শুভাপ্রসন্নর মিথ্যে তথ্য!

No comments:

Post a Comment