সম্পাদকীয় ১ (সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা)
ক্রান্তিকাল
১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০০:০০:১৬
রজত মজুমদার পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের একটি শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অবসরগ্রহণের অব্যবহিত পরেই তিনি রাজনীতিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত লইয়াছিলেন। ইহা আইনে আটকায় না। কিন্তু ঔচিত্যবোধ আইনের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নহে। সেই ঔচিত্যবোধ এই সিদ্ধান্তের যাথার্থ্য লইয়া বিলক্ষণ প্রশ্ন তুলিবে। বিশেষত, তাঁহার গ্রেফতারির পর। কাহারও গ্রেফতার হওয়া এবং তাঁহার অপরাধ প্রমাণিত হওয়া অবশ্যই এক কথা নহে। আইনের চোখে রজতবাবু এখনও নিরপরাধ। কিন্তু, অকারণে কেহ গ্রেফতার হন না। মনে করিবার কারণ আছে, তিনি তদন্তকারীদের সহিত যথেষ্ট সহযোগিতা করেন নাই। বস্তুত, সারদা গোষ্ঠীর সহিত তাঁহার সম্পর্ক সম্বন্ধে তিনি ইতিপূর্বে যাহা বলিয়াছেন, তাহার সবই যে সত্য ছিল না, তাহা ইতিমধ্যেই প্রকাশিত। আরও প্রশ্ন, যাঁহার চাকুরিজীবনের একটি বড় অংশ গোয়েন্দা বিভাগে কাটিয়াছে, তিনি সারদা গোষ্ঠীর স্বরূপ টের পান নাই? কেন তাঁহার অবসরগ্রহণের পরেই একটি সংস্থা তাঁহাকে প্রায় দশ গুণ বেতনের চাকুরি দিতেছে, তিনি বোঝেন নাই? তিনি যে সজ্ঞানে, সম্ভবত দলীয় নির্দেশেই, সারদা গোষ্ঠীর সহিত যুক্ত হইয়াছিলেন, তেমন অনুমানের যথেষ্ট কারণ আছে।
ব্যক্তি অকিঞ্চিৎকর। ভূতপূর্ব ডিজির প্রকৃত গুরুত্ব প্রতীক হিসাবে। পশ্চিমবঙ্গে এখন যে ক্রান্তিকাল চলিতেছে, তাহার প্রতীক। প্রাক্তন সহকর্মীরা যাঁহাকে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে চিহ্নিত করিতেছেন, সেই ব্যক্তি পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের অন্দরমহলের বাসিন্দা। সারদা গোষ্ঠীর ন্যায় এক ভুঁইফোঁড় সংস্থায় প্রশ্নযোগ্য কাজে যুক্ত থাকা রজতই এই রাজ্যেই দুইটি অতি জরুরি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ছিলেন, সম্ভবত এখনও যুক্ত আছেন। সততা বা স্বচ্ছতা হয়তো বর্তমান শাসকদের চোখে যোগ্যতা রূপে বিবেচিত হয় না। বস্তুত, দলীয় স্বার্থ রক্ষা ভিন্ন রাজ্যের জন্যও যে তাঁহাদের কিছু করণীয় আছে, পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের দেখিয়া বুঝিবার উপায় নাই। এক ভূতপূর্ব পুলিশ অফিসারের হুঁশিয়ারির পরেও মুখ্যমন্ত্রী নির্বিকার থাকিয়াছেন। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের তরফে সঞ্চয়ের বাজারে বিপুল গরমিলের খবর পাইয়াও অমিত মিত্র রা কাড়েন নাই। প্রশাসনও যেন শাসকদের যোগ্য হইয়া উঠিয়াছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট-কে সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তের উপযুক্ত জ্ঞান করিতেন ও দৃশ্যত এখনও করেন, তাহাদের বিরুদ্ধে তথ্য লোপাটের অভিযোগ উত্তরোত্তর প্রকটতর হইয়া উঠিতেছে। সন্দেহ প্রবল যে, সত্যসন্ধান নহে, ক্ষমতাসীনদের পিঠ বাঁচানোই সেই তদন্তকারী দলের কাজ ছিল। অনুমান করা চলে, তাহা রাজনৈতিক নির্দেশ মোতাবেকই হইয়াছিল, কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করিবার মতো মেরুদণ্ড এই রাজ্যের প্রশাসনের নাই।
পশ্চিমবঙ্গে এখন যে অন্ধকার নামিয়া আসিয়াছে, তাহা আক্ষরিক অর্থেই অ-পূর্ব। গত শতাব্দীর বহুচর্চিত ষাট-সত্তরের দশকের সহিতও তাহার তুলনা চলে না। তখন রাজনৈতিক হিংসা ছিল, বিপরীতে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন ছিল। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ শাসক দলের প্রায় সব নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন পাইকারি ভ্রষ্টাচারের অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গে কখনও উঠে নাই। এত ধোঁয়ার পিছনে কোনও আগুন নাই? সিপিআইএম-এর আমলেই যে এই ক্রান্তিকালের বীজ বপন হইয়াছিল, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটও অস্বীকার করিবে না। কিন্তু, গত তিন বৎসরে পশ্চিমবঙ্গ যে অতলে নামিয়া গিয়াছে, তাহা অকল্পনীয়। এই অন্ধকার পার হওয়া সম্ভব, কিন্তু তাহার জন্য শুধু সিবিআই, আদালত বা সংবাদমাধ্যমের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিলে চলিবে না। নাগরিক সমাজকে জাগিতে হইবে। আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তর হইতে নৈতিকতার কণ্ঠস্বরকে আত্মপ্রকাশ করিতে হইবে। সদর্থক বিরোধী রাজনীতিকে সক্রিয় হইতে হইবে। সম্মিলিত চেষ্টা ব্যতীত এই ক্রান্তিকাল ফুরাইবে না।
No comments:
Post a Comment