বিমর্ষ মমতা
পি এম পি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম ডেস্ক : ঠিক দুই বছর আগে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে উদ্যম নিয়ে নতুন সরকারের কার্যভার নিয়েছিলেন, দুই বছরের মাথায় সেই জোশ অনেকটাই উধাও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা এখন অনেকটাই বিমর্ষ। অনেকটাই ম্রিয়মাণ। দুই বছরের সাফল্য দাবি করতে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। পরিবর্তে তা করেছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। তবে গত রোববার দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির দিনে এক ফেসবুকবার্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, নতুন একটি সরকারের মূল্যায়নের জন্য দুই বছর খুব একটা বড় সময় নয়। দীর্ঘ ৩৪ বছরের জমানার ছায়া, দুই লাখ কোটি টাকারও বেশি ঋণের বোঝা এবং সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও মনোবলহীন প্রশাসন যন্ত্র এই সরকারের মাথার ওপরে ছিল। তবুও মানুষের অনুপ্রেরণা এবং নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন আমাদের অফুরন্ত উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে সাহায্য করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, মমতার সরকারের প্রথম এক বছরে যে সাফল্য এসেছিল তা দ্বিতীয় বছরে দেখা যায়নি। বরং সঙ্কট আরও বেড়েছে।
তবে এই দুই বছরে মমতার কর্মপদ্ধতির তেমন কোনও পরিবর্তন না হলেও তার জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মহাকরণে তার এন্টিচেম্বারে অবশ্য নিয়ম করে তিনি নতুন ছবি এঁকে চলেছেন। ছবি আঁকাতেই মমতা হতাশা কাটিয়ে নতুন করে উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ার রসদ পান বলে মনে করেন। তবে পুলিশবেষ্টিত হয়ে না চলার সিদ্ধান্ত থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। হুটার লাগানো গাড়ি ব্যবহার না করলেও এখন তার শাড়িতে অভিজাত রুচিশীলতার ছাপ দেখা যাচ্ছে। আজকাল প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তাল মিলিয়ে শাড়ির পাড়ের রঙ বদল ঘটতেও দেখা গেছে। বদল হয়েছে মমতার চিরাচরিত নীল হাওয়াই চটিরও। এখন তিনি পরেন সাদা হাওয়াই চটি। স্ট্র্যাপ থেকে জমি সবই সাদা। আর নোকিয়াভক্ত মমতা আজকাল ব্ল্যাকবেরি ব্যবহারেও বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। পাহাড় বা জঙ্গল মহলের হাসি ছবিতে ধরে রাখতে অ্যাপল আইপ্যাডও ব্যবহার করেন। হাতে মায়ের দেয়া রুপোর চুড়িটি এক জনসভায় চুরি হয়ে গেলেও এখন সেই রকমই একটি রুপোর বালা পরেন তিনি। চামড়ার স্ট্র্যাপের ঘড়িও তার একটা স্টাইল। সম্প্রতি গায়ে ঢাকা দেয়ার জন্য সবসময় সাদা চাদর ব্যবহার করেন।
এসব পরিবর্তনের সঙ্গে মমতার ভাষারও বেশ পরিবর্তন হয়েছে। বিরোধীদের আক্রমণে ভাষার ক্ষেত্রে তিনি লাগামছাড়া। তবে এতকিছু পরিবর্তন সত্ত্বেও মমতার এখন ঘুম ছুটে গিয়েছে। একের পর এক অঘটনে তিনি এতটাই বিব্রত যে ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি অনেক সময়ই তার হতাশা প্রকাশ করে ফেলছেন। আর দলের নেতাদের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে তিনি এতটাই বীতশ্রদ্ধ যে মাঝে মাঝেই দলীয় সভায় সে বিষয়ে সতর্ক করেও দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে তাতে কোন কাজ হচ্ছে না। দলীয় নেতাদের আবদার মেটানো সম্ভব না হওয়ায় অনেক শিল্পই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। সরকারের প্রথম বছরের অনেক সাফল্যই দ্বিতীয় বছরে দেখা যায়নি। বরং রাজনৈতিক হানাহানি বেড়েছে। মমতা অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি কাউকেই রেয়াত করেন না। আর তাই দলের নেতা থেকে কাউন্সিলরদের জেলে পুরতেও দ্বিধা করেননি।
কিন্তু পূর্ববর্তী সরকারের মতোই শিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্র কায়েমের নির্লজ্জ প্রয়াস দেখা গেছে। আর তাই দুই বছরের পূর্তিতে মমতার মুখে কোন উৎসাহের রেশ নেই। কয়েক দিন আগে অর্থমন্ত্রী সরকারের দুই বছরের রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ করে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে সারা ভারতের গড়ের চেয়ে অনেক উপরে। সারা ভারতের গড় গত বছরে যেখানে ছিল ৪.৯৬ সেখানে পশ্চিমবঙ্গের গড় একই সময়ে ৭.০৬। অবশ্য বিরোধীরা এই দাবিকে মানতে রাজি নন। কংগ্রেস তো পাল্টা রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ করে দেখিয়ে দিয়েছে মমতার সরকার গত দুই বছরে দিশাহীনভাবে চলেছে। শিল্পে বড় কোন বিনিয়োগ হয়নি। জমিজটে আটকে গেছে সব কাজ। আর কৃষিক্ষেত্রে সঙ্কট প্রবল হয়েছে।
অবশ্য সরকার দাবি করেছে, বোরো চাষে পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের মধ্যে প্রথম। তবে মমতা ঘনিষ্ঠদের মতে, দিদি রাজ্যের উন্নয়নের জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন। মন্ত্রীদের কাজকর্মের ওপর তিনি নিজে নজরদারি করছেন তেমনি শিল্প নিয়েও তিনি সম্প্রতি নিজেই দায়িত্ব নিয়েছেন দেখভালের। আসলে সরকারের কাজ যে ঠিকভাবে চলছে না মমতার এসব সিদ্ধান্তই তার প্রমাণ বলে দাবি করেছেন বিরোধী সিপিআইএমের এক নেতা।
তবে সাম্প্রতিক চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির ঘটনায় মমতা এতটাই ধাক্কা খেযেছেন যে, তার ভোট ব্যাঙ্কেও চিড় ধরার প্রবল আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় তৃণমূলের প্রতি আস্থা অনেকটাই চটকে গিয়েছে। শহুরে এলাকায় একটু কান পাতলেও শোনা যাচ্ছে, এই পরিবর্তন কি আমরা চেয়েছিলাম? এ কোন কুমির ডেকে আনলাম? তবে সারধা গোষ্ঠী যেভাবে লাখ লাখ মানুষকে নিঃস্ব করেছে তার দায় এড়ানোর জন্য মমতা অনেক চেষ্টা করলেও এটা সবাই জানেন যে, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও মন্ত্রীদের একাংশের সমর্থনেই সারধা গোষ্ঠীর পাশাপাশি অনেক চিট ফান্ড ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। এই চিট ফান্ডগুলির অর্থে পরিচালিত টিভি ও সংবাদপত্রে যে মমতা ভজনা গত দুই বছর ধরে চলেছে তা সকলেই দেখেছেন। আর কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর জানা গেছে, অনেক তৃণমূল নেতাই চিট ফান্ডের অর্থে ব্যক্তিগত সম্পদ তৈরি করেছেন। সরকার সেসব দেখেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি। শেষ মুহূর্তে দলের মন্ত্রী-এমপিদের আড়াল করতে মমতা প্রকাশ্য জনসভায় পাল্টা আক্রমণে গিয়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন, কুনাল চোর, টুম্পাই (সঞ্জয় বসু) চোর, মদন মিত্র চোর, আমি চোর, আর ওরা (বিরোধীরা) সব সাধু। কিন্তু তিনি যা-ই বলুন না কেন, সারধা কেলেঙ্কারির ধাক্কা সামলাতে তিনি দলের দুর্নীতিগ্রস্তদের সরিয়ে দিলে যে দলের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হতো সে কথা কবুল করেছেন তার দলের সংসদ সদস্যরাই। দলের মধ্য থেকেও এমন দাবি উঠেছিল। তিনি কোন ব্যবস্থাই নেননি কলঙ্কিতদের বিরুদ্ধে।
তবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য ৫০০ কোটি রুপির তহবিল ঘোষণা করে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু এই অর্থের একটি অংশ সিগারেটের ওপর কর বসিয়ে তোলার জন্য সবাইকে বেশি বেশি সিগারেট পানের পরামর্শ দিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলেছেন। ঠিক যেভাবে তিনি কোন ঘটনার তদন্ত শুরুর আগেই বলে দেন ওসব সাজানো। সারধা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্ত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই-এর হাতে তুলে দেয়ার ব্যাপারে তার আপত্তিকেও মানুষ ভাল চোখে দেখেননি। কিন্তু তিনি অনড়। তার এই ধরনের অনড় মনোভাবের জন্য সরকার মাঝেমাঝেই অযথা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। আদালতে লেজেগোবরে হয়েছে। কিন্তু মমতা থেকেছেন মমতাতেই।
তবে কিছুদিন হলো একটা জিনিষ তিনি ঠিক করে নিয়েছেন, তার উত্তরসূরি বাছাই করার কাজটা এখনই শুরু করে দিতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে তার ভাইপো এমবিএ শিক্ষিত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। দলের যুবা সংগঠনের প্রধান এই অভিষেক। সম্প্রতি এক সম্মেলনে অভিষেকের মতো যুবাদেরই সামনের সারিতে এগিয়ে আসার ওপর জোর দিয়েছেন মমতা। রোববার কলকাতার রাজপথে সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির মিছিলের নেতৃত্বেও দেখা গেছে অভিষেককে। বিরোধীদের মতে, মমতাও পরিবারের মধ্য থেকেই উত্তরসূরি বাছাই করার পথে চলেছেন।
No comments:
Post a Comment